মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আপনি সেদিন বলেছিলেন মানুষ চিরঞ্জীব, মানুষের মৃত্যু নেই। কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি হুজুর?
উত্তর: মৃত্যু হচ্ছে আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে একটা ঝিল্লিসম পর্দা বিশেষ পর্দাটা সরে গেলেই মানুষ চলে যায় তার গন্তব্যে, মাটির দেহটা পড়ে থাকে পেছনে। সেজন্যেই মৃত্যুকে আমরা ইন্তেকাল বা স্থানান্তর গমন বলি, হিন্দুরা বলে পরলোক গমন। কোরআনে বলা হয়েছে প্রত্যেক মানুষই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, মরবে এ কথা বলা হয়নি। কিন্তু তার আগে প্রশ্ন করা উচিত, মানুষ হয়ে মরে ক’জন?
প্রশ্ন: ‘জন্মিলে মরিতে হয়’ এই তো নিয়ম, এর মধ্যে আবার মানুষ হবার প্রশ্ন কেন?
উত্তর: মানুষ মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ঠিকই, কিন্তু সব মানুষ মানুষ হয়ে মরে না। মানুষের জন্ম হয় মাসুমিয়াত বা নিষ্পাপ অবস্থার মধ্যে। কিন্তু তার মধ্যে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে নফ্স এবং রুহের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। যে মানুষ নফস বা প্রবৃত্তির দাস হয়ে তার স্রষ্টাকে বিস্মৃত হয় তার মধ্যে মনুষ্যত্বের কিইবা অবশিষ্ট থাকে? এমন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে একটা পশুর তফাৎ কি বল। সেজন্যেই বললাম মানুষ হয়ে মরে ক’জন। যাঁরা মানুষ হতে পারে, তাঁদের মৃত্যু নেই। তাঁরা আল্লাহর চিরঞ্জীব সত্তায় বিলীন হয়ে যায়।
প্রশ্ন: এ ধরণের মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য কি?
উত্তর: এ ধরণের মানুষের সবচেয়ে বড় ফিতরত বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ঈমান।
প্রশ্ন: ঈমানের কথা তো সবাই আমরা মুখে উচ্চারণ করি।
উত্তর: না, শুধু উচ্চারণ করার নাম ঈমান নয়। ঈমান হচ্ছে প্রগাঢ় বিশ্বাস তাঁর একক চিরঞ্জীব সত্তায়। বিশ্বাস তাঁর রাসূল (সাঃ)-এ যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্যে রহমতস্বরূপ। কিন্তু এ বিশ্বাসের প্রধানতম সিফত বা গুণ হচ্ছে সবর বা ধৈর্যধারণ করা। পার্থিব জীবনে সুখ যেমন তাঁর অনুগ্রহ, দুঃখও তেমনি তাঁরই অনুগ্রহ, এমন একটা অটল বিশ্বাসে যারা অবিচল চিত্তে জীবনের মুখোমুখি হন, তারই সবরকারী। এদের জন্যে কোন বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাস দেয়া হয়নি। আল্লাহ্ স্বয়ং এদের পুরস্কার অর্থাৎ আল্লাহ্ নিজেই এদের হয়ে যান। নবীদের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে সবরই তাঁদের চরিত্রের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। হযরত ইউসুফ (আঃ) কারাগারে গিয়ে অধৈর্য হননি। হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে গিয়ে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস হারাননি।
প্রত্যেক নবীই অসীম নিগ্রহ ভোগ করেছেন মানুষের হাতে কিন্তু তাঁরা অবিচল চিত্তে সব যাতনা সয়েছেন। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, কেউ এক গালে চড় দিলে অন্য গাল বাড়িয়ে দিও। এখানেও সবরের কথাই বলা হচ্ছে। কিন্তু সবরের মর্যাদা যেমন উচ্চে তেমনি এর পরীক্ষাও অতি কঠিন। আল্লাহ্ এ ধরনের বান্দাকে প্রভূত পার্থিব অনুগ্রহ দিয়ে আবার তার সর্বস্ব হরণ করেও পরীক্ষা করেন। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন-“ওয়ালা নাবলুওয়ান্নাকুম বিশাইয়িম মিলান খাওফি ওয়াল জু’য়ে ওয়া নাক্বসিম মিনাল আমওয়ালি ওয়াল আনফুসি ওয়াস সামারাত” [সূরা বাকারা/১৫৫] অর্থাৎ আমি তোমাদের ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করবো। একই সঙ্গে আল্লাহ্ শুভ সংবাদ দিচ্ছেন ধৈর্যশীলদের যারা যে কোন অবস্থাতেই আল্লাহর ইচ্ছাকে সর্বান্তঃকরণে মেনে নিয়ে বলে আমরা তো তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করবো।
প্রশ্ন: আল্লাহর ইচ্ছার কাছে যে আত্মসমর্পণ করে তার তো চাইবার কিছু থাকে না একমাত্র স্বয়ং আল্লাহ্কে ছাড়া?
উত্তর: তুমি ঠিক বলেছো। সেজন্যেই ধৈর্যশীলদের পুরস্কার প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা নাহল-ের ৯৬ নং আয়াতে বলেছেন, “মা ইনদাকুম ইয়ানফাদু ওমা ইন্দাল্লাহি বাক্বি ওয়ালা নাজযিইয়ান্নাল্লাজিনা সাবারু আজরাহুম বিআহসানি মা-কানু ইয়া মালুন” । অর্থাৎ তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে তা চিরস্থায়ী। নিশ্চয়ই আমি ধৈর্যশীলদের তাদের কাজ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দেব।
প্রশ্ন: কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ এই সবরের মাকাম হাসিল করতে পারবো না। আমরা তো গুনাহ্ করছি-হরদম করছি। শান্ত চিত্তে তাঁর ইচ্ছাকে মেনে নিতে পারছি কোথায়?
উত্তর: সে জন্যেই বলা হয়েছে নিরাশ হয়ো না। নিরাশ হওয়াটা কুফরির সামিল (সূরা ইউসুফ, আয়াত নং ৮৭)। দেখ, তোমরা গুনাহ্ বলতে কি বোঝ জানি না। আসলে আমি বোধহয় সওয়াব গুনাহ্ কোনটাই বুঝি না। তবে গুনাহ্ জিনিসটাকে সামান্য বোঝার চেষ্টা করে যেটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয় মানুষের দেহের সঙ্গে এর একটা তুলনা চলে। দেখবে তোমার দেহ এমন কিছু গ্রহণ করে না যা তোমার দেহের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এমন রক্ত তোমার জন্যে মৃত্যুর সমান। এমন খাদ্য তোমার জন্যে বিষ। মানুষের দেহের যেমন কিছু অ্যান্টিজেন বা বিষবৎ কিছু তৈরীর শক্তি আছে, মানুষের আত্মারও তেমনি কতগুলো বৈরী শক্তি আছে। এই বৈরী শক্তিগুলোকে আত্মা গ্রহণ করতে রাজি হয় না। কিন্তু আত্মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন তা গ্রহণ করা হয় তখন আত্মা রোগগ্রস্ত হয়, এরই নাম গুনাহ্। দেহের ক্ষেত্রে একে আমরা বলি অসুস্থতা। দেহ অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে দৌঁড়াই। কিন্তু আত্মা অসুস্থ হলে নিজের কাছে নিজেই তা স্বীকার করি না।
কিছু লোক মনে করে জীবন তো পড়েই আছে, একবার তওবা করে নিলেই চলবে। এত তাড়াতাড়ি কিসের। কিন্তু এদের জীবনের শেষে তওবা আল্লাহ্ কবুল করবেন না। আল্লাহ্ তায়ালা স্পষ্ট বাক্যে বলছেন, তওবা এদের জন্যে নয়। কিংবা তওবা তাদের জন্যেও নয় যারা কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে (সূরা নিসা/১৮) ।
প্রশ্ন: কাফিররাই তো কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং তাদের আবার তওবা কিসের?
উত্তর: ভুল করছো কোন কোন মুসলমানও কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে পারে। ঈমান যার নেই তাকেই তো আমরা কাফির বলি, তাই না। রাসূলে পাক (সাঃ) সত্তর রকম কবিরা গুনাহ-এর কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে সতেরটি কবিরা গুনাহ্ আছে যা করলে ঈমান থাকে না। তওবা করে কলমা না পড়লে সে কাফেরই থেকে গেল এবং এ অবস্থায় মৃত্যু হলে সে তো কাফের হয়েই মরলো।
প্রশ্ন: এ সতেরোটি গুনাহ্ কি?
উত্তর: এ গুনাহ্গুলোর কিছু আমরা কল্ব দিয়ে করি, কিছু করি জবান বা মুখ দিয়ে, কিছু হাত দিয়ে, কিছু গোপন অঙ্গ দিয়ে। এগুলো হচ্ছে,
১। আল্লাহ্কে অস্বীকার করা।
২। অনুতপ্ত না হয়ে একই গুনাহ্ বার বার করা;
৩। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া;
৪। আল্লাহর গজবের পরোয়া না করা;
৫। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া;
৬। কোন নিষ্পাপ মহিলার চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করা;
৭। মিথ্যা কসম খাওয়া;
৮। যাদুটোনা, তাবিজ দিয়ে কারো ক্ষতি করা;
৯। মদ্যপান করা, যতক্ষণ নেশা থাকে ততক্ষণ ঈমান থাকে না;
১০। ইয়াতিমের হক মারা;
১১। সুদ খাওয়া;
১২। নিজের গোপনাঙ্গের হেফাজত না করা;
১৩। সমকামিতায় অংশগ্রহণ করা;
১৪। নিজের পুরুষত্ব নষ্ট করে ফেলা;
১৫। কাউকে হত্যা করা;
১৬। চুরি করা;
১৭। সন্তানের পক্ষে বাবা-মার মনে কষ্ট দেয়া।
উপরের এ কাজগুলোর প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে কাজ করার এরাদা বা ইচ্ছা করার মূহুর্ত থেকে কাজ সম্পন্ন হবার পর তওবা না করা পর্যন্ত একজন বিশ্বাসীরও ঈমান থাকে না। সুতরাং এ অবস্থায় মৃত্যু হলে মুসলমান বলে পরিচিত ব্যক্তিও কাফেরের মৃত্যুরবণ করলো। কিন্তু আল্লাহ কত মেহেরবান তা আমরা সজ্ঞানে উপলব্ধি করি না। সত্যিকারের তওবা করে যে সৎ পথে চলার চেষ্টা করে এবং বড় গুনাহ্ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে আল্লাহ না চাইতেই সে বান্দার ছোটখাটো গুনাহ্ মাফ করে দেন (সূরা নিসা/১৭) ।
সুতরাং এসো আবার মানুষের দেহের উপমাটায় ফিরে আসি। গুনাহ্ যদি দেহের অসুস্থতার মতই আত্মার অসুস্থতা হয়-তবে তওবা হবে রোগগ্রস্ত আত্মার জন্যে ঔষুধস্বরূপ। আত্মা রোগমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সবর হাসিল করা যায় না, ঠিক যেমন দেহ রোগমুক্ত না হলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায় না। আধ্যাত্মিক জগতে সবরই হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। স্রষ্টাকে সকল কাজের নিয়ামক শক্তি হিসেবে সর্বান্তঃকরণে মেনে নেবার নামই সবর। এই মেনে নেবার নিরন্তর সংগ্রামের নামই হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনা।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন