মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আজকে আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। আমার প্রতিবেশী করিম সাহেবের বাসায় দাওয়াত ছিল। ভদ্রলোক খুব ভাল, একেবারে ফেরেশতার মতো মানুষ।
উত্তর: ভাল প্রতিবেশী পাওয়া খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।
প্রশ্ন: ভদ্রলোক নামাজ রোজা তো করেনই, প্রচুর দান খয়রাতও করেন।
উত্তর: আচ্ছা ভাল মানুষকে তোমরা ফেরেশ্তার সঙ্গে তুলনা কর কেন?
প্রশ্ন: ভাল মানুষকে আমরা ফেরেশতা বলি, তবে কেন বলি তাতো ভেবে দেখিনি হুজুর।
উত্তর: অর্থাৎ ফেরেশতা মানুষের চেয়ে বড় এমন একটা ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে বলেই মানুষ এ কথা বলে।
প্রশ্ন: সে কথা ঠিক।
উত্তর: কিন্তু ফেরেশতা কি মানুষের চেয়ে সত্যি বড়? আল্লাহ কাকে আশরাফুল মাখলুকাত বলেছেন?
প্রশ্ন: মানুষকে।
উত্তর: তাহলে স্বীকার করতেই হয় ফেরেশতার স্থান মানুষের নীচে।
প্রশ্ন: জী তা তো স্বীকার করতেই হয়।
উত্তর: তাহলে ভালো ফেরেশতাকে তুলনা করতে হলে বলতে হবে অমুক ফেরেশতা মানুষের মতো।
প্রশ্ন: আপনি মাঝে মাঝে এমন করে কথা বলেন, বড় অসুবিধে হয় বুঝতে।
উত্তর: কথা তো কঠিন কিছু বললাম না। তোমরাই বল মানুষ সৃষ্টির সেরা। ফেরেশতাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাহলে মানুষ ফেরেশতার চাইতে বড়। এর মধ্যে কঠিন কি দেখলে।
প্রশ্ন: আপনার যুক্তি অকাট্য। কিন্তু যে মানুষ খুন করে, ব্যভিচার করে, জুলুম করে সেও কি ফেরেশতার চাইতে বড়?
উত্তর: এবার একটা ভালো প্রশ্ন করেছ তবে প্রশ্নটা হওয়া উচিত সে আদৌ মানুষ কিনা? ফেরেশতার সঙ্গে তুলনা চলে না এ জন্য যে ফেরেশতার তো ইচ্ছার স্বাধীনতা নেই। সে অনন্তকাল ধরে তাকে অর্পিত কাজ করে যাচ্ছে। তার ব্যত্যয় হবার কোন সুযোগই নেই। মানুষের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রশ্ন: একটু বুঝিয়ে বলুন।
উত্তর: মানুষের একদিকে রয়েছে একটি দেহ। অন্যদিকে একটি মন। দেহের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয়গুলোর নিজস্ব কোন ভাল-মন্দের ব্যাপার নেই। এগুলো হচ্ছে যন্ত্রবিশেষ যা মানুষ তার প্রয়োজনে ব্যবহার করে। মানুষের মধ্যে দেহজ উপাদান বা আনাসিরের কারণেই রয়েছে ষড়রিপু বা নফ্স। এই রিপুগুলো তার মধ্যে নিরন্তর পশু প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। ভেবে দেখো, অন্যান্য জীবের মতো মানুষকেও তিনটা জিনিস কারো কাছে শিখতে হয় না। নিদ্রা, খাওয়া এবং যৌনতা। এ তিনটি জিনিষ তার অস্তিত্বের সঙ্গেই মিশে আছে স্বজ্ঞা হয়ে। দেহের বিবেচনায় মানুষতো আসলে একটা পশু। তার মধ্যে প্রবৃত্তি যখন প্রবল প্রতাপে জাগ্রত হয় তখন তার মধ্যে আর পশুতে কোন তফাৎ থাকে না। কিন্তু সে সম্পূর্ণত পশুও হতে পারে না তার বিবেকের জন্য। বিবেক তাকে ভালমন্দের তারতম্য বুঝতে শেখায়। কিন্তু ভালো কাজের দিকে সে ধাবিত হবে কিনা সেটা নির্ভর করবে তার ইচ্ছা এবং কর্মের উপর।
প্রশ্ন: অর্থাৎ জন্মগতভাবে কাউকে ভালো কিংবা মন্দ কোনটাই বলা যাবে না।
উত্তর : ঠিক তাই। মানুষের গুন বা সিফাত কোন স্বভাবগত জিনিষ নয়। তার মধ্যে গুণ এবং নিগুণের সম্ভাবনা-দুই-ই রয়েছে। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য দেহ নামক একটা আশ্চর্য সুন্দর যন্ত্রও তাকে দেওয়া হয়েছে। তুমি আফলাতুন (চষধঃড়) এবং আরিস্তু (অৎরংঃড়ঃবষ) এর নাম শুনেছো। আফলাতুন মনে করতেন গুণ মানুষের স্বভাবগত অর্জন। কিন্তু আরিস্তু বলতেন গুণ হচ্ছে কর্মের মাধ্যমে অর্জনের জিনিষ। এ গুন বা সিফাত অর্জনের জন্য মানুষ যখন তার দেহকে ব্যবহার করে তখনই সে সাধক হয়। এরই নাম সাধনা।
প্রশ্ন: নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এগুলো কি সাধনা নয়?
উত্তর: এগুলোর মধ্যে সাধনা নেই এ কথা বলা যাবে না। তবে সাধনা আরো গভীরতর জিনিষ।
প্রশ্ন: বুঝলাম না।
উত্তর: নামাজ রোজা হজ্ব যাকাত এগুলো শরীয়তের হুকুম আহকামের জিনিষ। এ হুকুম পালন করার পরও একজন মানুষের প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রন নাও থাকতে পারে। প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্যই সাধনার প্রয়োজন। সাধনার দ্বারাই মানুষ দেহ ও মনের ভারসাম্য অর্জন করে। ভারসাম্য নষ্ট হলেই দেহ ও মন দুটিই রোগগ্রস্থ হয়। এই রোগগ্রস্থ মানুষই হলো মোহগ্রস্থ মানুষ।
প্রশ্ন: এই মোহই তাহলে মানুষ এবং তার অপরাধের মধ্যে একটা আড়াল সৃষ্টি করে।
উত্তর: ঠিক তাই। মানুষের মোহ যখন নিরন্তর সাধনা বা রিয়াজতের মাধ্যমে কেটে যেতে থাকে তখনই তার অন্তরের চোখ খুলে যায়। একেই শাস্ত্রকাররা বলেছেন তৃতীয় নয়ন। আর এ তৃতীয় নয়ন খুলে গেলেই মানুষ নিজের মধ্যেই তার আরাধ্যকে দেখতে পায়।
প্রশ্ন: তাহলে সব মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত এমন কথা বলা কি উচিত?
উত্তর: ওটা মানুষের এক ধরনের অহংকার বা রিয়া। মানুষ ও কথা বলে আত্মতৃপ্তি পায়। কিন্তু সত্যিই কি সব মানুষ মানুষ? মানুষ হওয়া একটা কঠোর সাধনার ব্যাপার। আগে তো মানুষ হও, তারপরে তো সৃষ্টির সেরা হবে। যেখানে যাত্রার শুরু সেটাকে আর যাই বলো গন্তব্য বলো না। মানুষের কাছে দুনিয়া হচ্ছে সুন্দরী মহিলার মতো যার রূপের ছটা মানুষের চোখে মোহজাল বিস্তার করে, যার ছলনায় মানুষ বিমোহিত হয়। ইসলামে সাধনা মানে এই রূপসীর কাছ থেকে পলায়ন নয়। মুমিন এই রূপসীর পাশেই থাকবে, কিন্তু তার মোহজালে আবদ্ধ হবে না। ইসলামে যে মনুষ্যত্বের সাধনা তার অনন্যতা এখানেই। রাজহাঁসের মতো কাদা পানিতে চলবে অথচ শুভ্র পালকে কোন পঙ্কিলতা স্পর্শ করবে না। প্রবৃত্তি আছে অথচ প্রবৃত্তির দাসত্ব নেই, এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। এখানেই তার মনুষ্যত্ব।
প্রশ্ন: কিন্তু শয়তানতো এ সাধনার অন্তরায় হয়। মানুষকে বিপথে চালিত করে।
উত্তর: তিনটি বাস্তবতা প্রতি পলকে মানুষের সঙ্গে আছে। অথচ মানুষ তিনটি বাস্তবতাকেই ভুলে থাকে।
প্রশ্ন: সেগুলো কি হুজুর।
উত্তর: আল্লাহ, মৃত্যু এবং শয়তান। আল্লাহ মানুষের সঙ্গে আছে, মানুষ তাকে ভুলে থাকে। আর ভুলে থাকে বলেই সে বিপথে যেতে পারে। মৃত্যু তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে, কিন্তু মৃত্যুকে ভুলে আছে বলেই মানুষ কামনা-বাসনা নিয়ে এমন নিরুদ্বেগ জীবন যাপন করতে পারে। শয়তান যে তার মধ্যেই বসবাস করে সেকথাও মানুষ বেমালুম ভুলে থাকে। শয়তানের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজ্ঞানে চিন্তা করলেও মানুষ শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাচতে পারে। এই ভুলে থাকাটাকেই তোমরা কিন্তু জীবন বলো। সেজন্যই মৃত্যুকে তোমাদের এমন ভয়। মনে রেখো মুমিনের কোন মৃত্যু হয় না, মুমিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে মাত্র। তার কাছে জীবন-মৃত্যুর কোন পার্থক্য নেই। মুমিন জানতে চায় না জীবনের জন্য মৃত্যু, নাকি মৃত্যুর জন্য জীবন। সে জানে জীবন বলতে এ শরীর নয়, মৃত্যু বলতেও এ শরীর নয়। এক অর্থে যার নাম জীবন, তার নামই মৃত্যু।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন