মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: সহজ কথা সহজ করে বলা কঠিন হুজুর, কিন্তু আল-কোরআনের কোন কোন আয়াত এমনই সহজ সরল যে তার প্রকৃত অর্থ আন্দাজ করাই মুশকিল।
উত্তর: কোরআন সহজ ভাষাতেই ধর্মের কথা, মঙ্গল-অমঙ্গলের কথা বলেছে। কিন্তু এর অনেক কিছুই আপাতঃদৃষ্টিতে সহজ হলেও এর গভীরতর তাৎপর্য রয়েছে। কোরআনের অর্থের সাতটি পর্দা রয়েছে। সেজন্যেই এর শাব্দিক অর্থ বোঝা যায় হয়ত, কিন্তু মর্ম উপলব্ধি কঠিন। কোরআনকে জিন্দা মনে করে যে কায়মনোবাক্যে কোরআনকে হৃদয়ঙ্গম করতে চায় এবং আল্লাহর আনুগ্রহ কামনা করে, কোরআন তার সঙ্গে কথা বলে। তা তুমি কোন আয়াতগুলোর কথা বলছিলে, দু’একটা উদাহরণ দিলে বুঝবার চেষ্টা করে দেখতাম।
প্রশ্ন: কেন হুজুর, এই যে সূরা ত্বীন-এ আল্লাহ শপথ করেছেন যে সব জিনিষের নামে কসম করছেন, সে সব জিনিস এমনই সাধারণ যে তাতে অনেকেই বিশেষ করে শিক্ষিত সম্প্রদায়-মনে করে যে এ ধরনের শপথের কোন অর্থ হয় না। যেমন আল্লাহ শপথ করছেন ডুমুরের নামে, জলপাই-এর নামে, শপথ করছেন সুরক্ষিত শহরের নামে। আল্লাহ যখন সময়ের নামে শপথ করেন তখন বুঝতে পারি, কিন্তু এ সমস্ত জাতি সাধারণ জিনিসের নামে শপথ কেন করছেন বোঝা গেল না।
উত্তর: দেখ, তোমাকে মোবারকবাদ জানাই এজন্যে যে তুমি প্রশ্ন করেছে। এ সমাজে বহু লোক আছেন যারা এ আয়াতটি পড়েছেন কিন্তু প্রশ্ন করেননি। এদিকে হয়ত এ শপথের মর্মার্থও উপলব্ধি করতে পারেননি। এ আয়াতে মূল লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আল্লাহ যার জন্যে কসম খাচ্ছেন সেটা। আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম রূপে সৃষ্টি করেছেন। তাকে আহসানে তাকভীম করে বানিয়েছেন। এই তাকভিমিয়াত হচ্ছে একটা রহস্যময় মর্যাদাসম্পন্ন স্তর যা রুপের সর্বোচ্চ সীমান এর পরেই অরূপের শুরু যাকে আমরা আল্লাহর যাত বলি। মানুষকে আল্লাহ এত বড় মর্যাদা দিয়েছেন। সেজন্যেই মানুষ সৃষ্টির আশরাফ-সৃষ্টির সেরা। সুতরাং মানুষকে এত বড় মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা যেখানে দিচ্ছেন সেখানে তিনি শপথ করবেন এমন কোন বস্তুর যা কিনা তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে পবিত্র। সেটাই আমাদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আসলে তিনি ঠিক এ কারণেই এ জিনিসগুলোর নামে শপথ করছেন।
প্রশ্ন: বুজলাম না হুজুর। ডুমুর আর জলপাই কি এমন পবিত্র জিনিস?
উত্তর: হ্যাঁ পবিত্র জিনিস, বুঝতে পারছো না বলেই অবাক হচ্ছে। দেখ হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ যে বলছেন, আমি একটি ধনাগারে লুক্কায়িত ছিলাম, আমি নিজেকে
চিনতে চাইলাম, তাই তাঁর মধ্যে নিজেকে দেখতে চাইলাম। অন্যত্র বলা হচ্ছে, হে হাবিব, হে প্রিয় তুমি না হলে আমি এ বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং সবকিছু সৃষ্টির আগে আল্লাহ নূরে মোহাম্মদীয়কে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) সেই পবিত্র জ্যোতি যা আল্লাহরও অতি প্রিয়। তাই এই আয়াতে মানুষকে তার সর্বোচ্চ অনুগ্রহের কথা জানাতে গিয়ে আল্লাহ শপথ করছেন সে সমস্ত জিনিসের যা তাঁর হাবিবের অতি প্রিয় ছিল। হুজুর পাক (সাঃ) ডুমুর ফল জলপাই এর তেলে ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করতেন। জলাপাইও ছিল তার প্রিয় ফল। সুতরাং প্রেমিক আল্লাহ এখানে তার প্রেমাস্পদের প্রিয় বস্তুর শপথ নিয়ে কথা বলছেন। শপথ করছেন সে পবিত্র শহরের যে শহরের মাটি তাকে ধারণ করে ধন্য হয়েছে। আল্লাহ বলছেন, হে প্রিয় তুমি যে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে গেছ, সে মাটির কসম। আর শপথ করছেন তুর পর্বতের যেখানে তিনি তার নূরের একটি মাত্র পর্দা খুলেছিলেন। যার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে হযরত মুসা (আঃ) জ্ঞান হারিয়েছিলেন। এতগুলো শপথের পর আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম রুপে সৃষ্টির কথা বলছেন। সুতরাং এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো এক প্রেমিক অন্য প্রেমিকের প্রেমের উচ্ছাসে শপথ করছেন। ঠিক এমনি প্রেমের উচ্ছাসে রয়েছে সূরা মোজাম্মিলের শুরুতে। রাতের এবাদত করতে করতে দন্ডায়মান রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পা যখন ফুলে উঠেছে তখন প্রেমিক প্রেমাস্পদকে সন্বোধন করে বলছেন, হে কম্বলাবৃত, হে প্রিয়, রাত জাগ কিন্তু এত নয়, অর্ধ রাত্রি কিংবা তারও কম।
সুতরাং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মধ্যে এই গভীর প্রেমের সম্পর্ক যে না বুঝবে তার কাছে সূরা মোজাম্মিল বা সূরা ত্বীনের কোন অর্থ হবে না। আক্ষরিক অর্থ হয়ত একটা দাঁড়াবে কিন্তু প্রেমের উপলব্ধির গভীরতা অনুভব না করতে পারলে- এ হবে নেহাতই শুকনো প্রাণহীন বিদ্যা।
প্রশ্ন: হুজুর, এভাবে এ আয়াতগুলোকে উপলব্ধির চেষ্টা করিনি। ফলে প্রায়ই মনে হয়েছে এ একটি হাস্যকর শপথ। আল্লাহ যিনি তুলনাহীন তার পক্ষে এমন সামান্য জিনিসের কসম খাওয়া কি ঠিক হলো। এখন বুঝতে পারছি এ সামান্য জিনিস অসামান্য হয়েছে নূরে মোহাম্মদির স্পর্শে। হুজুর আর একটা আয়াত সম্পর্কে একটু কিছু বলুন। সূরার নাম মনে নেই হুজুর। ঐ যে আল্লাহ যেখানে বলছেন, হে মুমিনগণ। তোমরা রুকু করো, সেজদা করো, এবাদত কর এবং সৎ কাজ করো এ তো হুজুর অত্যন্ত সাধারণ কথা।
উত্তর: এটা সূরা হজ্জ্বের আয়াত। আল্লাহ এখানে বলছেন, হে ঈমানদারগণ যারা আমার এবং রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছো তোমরা রুকু করো, সেজদা করো, এবাদত করো তোমাদের প্রতিপালকের। এখানে শুধু আক্ষরিক অর্থই একমাত্র অর্থ নয়। রুকু কর, সেজদা কর, এবাদত করো, তাহলে এবাদত কি সেজদা এবং রুকু থেকে আলাদা কিছু। এর পরে সৎকর্মের কথাও বলা হয়েছে। তাহলে সৎ কর্মও কি এবাদত থেকে পৃথক কিছু? আক্ষরিক অর্থে দেখলে এও তোমাদের কাছে অতি সাধারণ মনে হবে। রুকু, সেজদা এগুলো নামাজের বিশেষ বিশেষ আসনের নাম। আল্লাহ কি এখানে কেবল আনুষ্ঠানিক শারীরিক কসরতের কথাই বলছেন, নাকি এখানে আর কোন গভীরতর অর্থ আছে?
প্রশ্ন: একটু বুঝিয়ে বলুন হুজুর।
উত্তর: আল্লাহ বলছেন হে ঈমানদারগণ তোমরা আমাকে রুকু কর মানে সম্মান কর। সেজদা কর মানে হচ্ছে আত্মসমর্পন কর। আর এবাদত কর মানে হচ্ছে আমার গোলামি। আমার ক্রীতদাসত্ব স্বীকার কর। অর্থাৎ হে মুমিন তোমার এ জীবন উৎসর্গ কর আমার প্রতি, পরিপূর্ণভাবে, হৃদয়ের আরতি দিয়ে, নিঃশেষে, শর্তহীন শর্তে। আর এ সবই পূর্ণতায় উদ্ভাসিত হবে যখন তুমি সৎ কাজ করবে। আর সে সৎ কাজ হচ্ছে আল্লাহর মাখলুকের জন্যে আত্মত্যাগ। ত্যাগই মানুষকে সত্যিকারের ভোগের মহিমা দিতে পারে। সেজন্যেই দেখ, নামাজের কথা যতবার বলা হয়েছে ততবারই যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ত্যাগ যেখানে নেই সেখানে প্রেম নেই, আর প্রেম যেখানে নেই সেখানে ধর্ম নেই। যারা ধর্মের মর্মমূলে প্রেমকে উপলব্ধি করেন না তাদের কাছে রুকু রুকুই, সেজদা সেজদাই। এক ধরনের শারীরিক কসরতই তাদের কাছে ধর্ম।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন