Mobile Menu

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)

শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন

প্রশ্নোত্তর পর্ব

(১৭)

মুক্তির অভিলাষ এবং পথভ্রষ্ট বাহাত্তর

প্রশ্ন: আপনি বিগত ২২ ডিসেম্বর জুমার নামাজে যে লিখিত ভাষণ দেন তা সম্মানিত সমাবেশকে পাঠ করে শোনানো হয়। আপনার স্বরভঙ্গজনিত কারণে আপনি নিজে তকরির করতে পারেননি। এ লিখিত ভাষণে আপনি বর্তমান বিশ্বে মতপার্থক্যে জর্জরিত ইসলাম এবং প্রকৃত মোহাম্মদি ইসলাম কি সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। অনেকেই সে ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছেন এবং তারা মনে করেন যে, এতে প্রকৃত মোহাম্মদি ইসলাম কোন পথে গেলে মিলবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।

 

উত্তর: বর্তমান বিশ্বে ইসলামের যা অবস্থা এবং এর মতপার্থক্য এবং ফেরকা এমন প্রবল যে, তাতে ইসলামের ভবিষ্যত সম্পর্কে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। অবশ্য আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ইসলাম তাঁর মনোনীত ধর্ম এবং ইসলামকে আল্লাহ নিজেই রক্ষা করবেন। তবু ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মাত্রই এ সংকট সম্পর্কে সচেতন হবার প্রয়োজন রয়েছে।

 

প্রশ্ন: হুজুর, এ সম্পর্কে কিছু বললে ধর্মপ্রাণ পাঠকসমাজ উপকৃত হবেন।

উত্তর: ইসলামের ৭৩ ফেরকার মধ্যে আজ মতবিরোধ তুঙ্গে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের নাজাত বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল বলে মনে করে। কিন্তু হাদিস অনুসারেই এদের মধ্যে একটি মাত্র ফেরকা মুক্তির পথ লাভ করবে। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দলটি নাজাত পাবে? প্রথমেই জানা দরকার, কোন দল সত্যিকার অর্থে হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এবং তার সাহাবিদের অনুসরণ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করছে।

 

প্রশ্ন: হুজুর, আপাতদৃষ্টিতে তো প্রত্যেকেই রাসূল (সাঃ)-কে এবং তার সাহাবিদের অনুসরণ করছে।

 

উত্তর: না, সত্যিকার অর্থে করছে না। কারণ, হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এবং তার সাহাবিরা এলমে শরিয়ত এবং এলমে মারেফত উভয় বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন এবং এই উভয় বিদ্যা তারা ব্যবহারিক জীবনে আমল করতেন। এছাড়া চার মাজহাবের ইমামগণ, দশ জন মোবাশশারা, আহলে বায়েত, সমস্ত রাসূল এবং নবি ও উভয় বিদ্যায় বিদ্বান ছিলেন এবং তাদের জীবনেও তারা এর আমল করেছেন। সুতরাং এ থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় যে, যারা এলমে শরিয়ত এবং এলমে মারেফত এ উভয় বিদ্যা শিক্ষা করবেন এবং আমল করবেন তারাই রাসূলে পাক (সাঃ)-এর খাটি উম্মত বা নাজাত প্রাপ্ত দল হবেন।

আর এর ব্যত্যয় যাদের বেলায় হবে তারা আর যাই হোক মোহাম্মদি ইসলামের পায়বন্দ হতে পারেন না। 

 

প্রশ্ন: হুজুর, কাউকে কাউকে কট্টর শরিয়তি হতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে তরিকতের কোন আমল লক্ষ্য করা যায় না। এরা তো ধর্মের অনুশাসন সবই মেনে চলছেন।

 

উত্তর: যারা শুধু শরিয়ত মেনে চলে তারা যেমন গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট, যারা শুধু মারেফত আমল করে তারাও তেমনি পথভ্রষ্ট। রাসূলে পাক (সাঃ) দীর্ঘ ১৫ বৎসর হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান বা মোরাকাবা করে হযরত জিবরিল (আঃ)-এর মাধ্যমে যে মহাশক্তি অর্জন করেছিলেন তরিকতের ভাষায় একেই বলে তাওয়াজ্জাহ। ঐ তাওয়াজ্জোহর বলেই তিনি নিজের মানব আবরণের আবর্জনা দূর করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। সেই তাওয়াজ্জোহর শক্তিতেই তিনি বর্বর আরব জাতিকে চরিত্রবান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর রাসূলের সিনা থেকে সেই তাওয়াজ্জাহ লাভ করে খোলাফায়ে রাশেদিন, আহলে বায়েত, আশরায়ে মোবাশশারা, আহলে সুফফাসহ বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরামগণ সম্মানের মুকুট পরিধান করেছিলেন। সেই তাওয়াজ্জোহ শক্তিই অলি আল্লাহদের মাধ্যমে আজ পর্যন্ত জারি আছে। যারা অলি আল্লাহদের সাহচর্য লাভ করে ঐ তাওয়াজ্জোহ অর্জন করতে পারেন তাদের ক্বলবই জিন্দা হয়। তাদের অন্তরই জীবন স্পন্দনে স্পন্দিত হয়। এরাই শরিয়তের ব্যক্ত বিদ্যা এবং মারেফতের গুপ্ত বিদ্যার আলোকে আলোকিত হন এবং নিজেদের জীবনে এ উভয়ে বিদ্যার হুকুমসমূহ পালন করে জীবনকে ধন্য করেন। এরাই হচ্ছেন তারা, যারা সঠিক পথে আছেন এবং এরাই হচ্ছেন রাসূলে পাকের মনোনীত নাজাতপ্রাপ্ত দল। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন: যাহাদের অন্তর আল্লাহর জেকের না করিবার জন্য কঠিন হইয়াছে তাহারা প্রকাশ্য গোমরাহির মধ্যে আছে। এবং তাহারাই ধ্বংস হইবে। অন্যত্র আল্লাহপাক বলেছেন, ঐ সকল লোকের তাবেদারী করিও না বা হুকুম মানিও না যাহাদের ক্বলব আমার জেকের হইতে গাফেল। উপরের দুটি আয়াত থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, যাদের অন্তর আল্লাহর জেকের বা স্মরণ দ্বারা উজ্জীবিত হয়নি তারা গোমরাহির মধ্যে নিমজ্জিত।

 

 

প্রশ্ন: সাহাবায়ে কেরাম যে এই দুই প্রকার বিদ্যা অর্জন করেছিলেন এ সম্পর্কে কোন তথ্য আমাদের জানা আছে কি?

 

উত্তর: নিশ্চয়ই আছে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি হযরত রাসূলে করিম (সাঃ)-এর কাছ থেকে দু’রকম বিদ্যা শিক্ষা করেছি। এর একটি আমি তোমাদের মধ্যে প্রকাশ করলাম। কিন্তু অন্যটি যদি প্রকাশ করি তবে আমার গর্দান কাটা যাবে। (বোখারী)

 

এ হাদিসটি থেকে বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম ঐ দু’ধরনের বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। এ দু’ধরনের বিদ্যা ছাড়া কারোরই পূর্ণ সংশোধন হতে পারে না। কেননা, এলমে শরিয়ত দ্বারা মানুষের জাহের বা বাইরের সত্তা সংশোধিত হয়। আর এলমে মারেফত দ্বারা সংশোধিত হয়। মানুষের অন্তর। শুধু জাহের শুদ্ধ হবার কোনই মূল্য থাকবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না বাতেন শুদ্ধ হয়।

 

প্রশ্ন: কথাটা আর একটু স্পষ্ট করে বলুন।

 

উত্তর: একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। ধরো, এক স্থানে তিনটি কলস আছে। প্রথম কলসটির উপরিভাগ এবং ভেতরের পানি দুই-ই পরিস্কার। দ্বিতীয় কলসটির উপরিভাগ অপরিস্কার কিন্তু ভেতরের পানি পরিস্কার। আর তৃতীয় কলসটির উপরিভাগ পরিস্কার কিন্তু ভেতরের পানি অপরিস্কার। এখন কেউ যদি পিপাসার্ত হয় তাহলে সে কোন কলসের পানি পান করবে। প্রথমে সে ঐ কলসের পানি পান করবে যার ভেতর-বাহির দুই-ই পরিস্কার। সে কলসে পানি না থাকলে সে চাইবে দ্বিতীয় কলসের পানি যার উপরিভাগ অপরিস্কার হলেও ভিতরের পানি পরিস্কার। কিন্তু সে কোন অবস্থাতেই ঐ কলসের পানি খাবে না যার উপরিভাগ পরিস্কার হলেও ভেতরের পানি অপরিস্কার। ঠিক এমনিভাবে উপরের পোষাক পরিচ্ছদ যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, বাহ্যত তুমি যতই আলেম, মওলানা, হাফেজ, কারি, পীর, সুফি যাই হও না কেন আল্লাহর কাছে তার কোন মূল্য নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার আত্মা শুদ্ধ হবে। কারণ আল্লাহ মানুষের অন্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, দেহের দিকে নয়। হাদিস শরিফে আছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ধনসম্পদ দেখেন না, তিনি কেবল তোমাদের অন্তর এবং নিয়তের দিকে দৃষ্টিপাত করে থাকেন (মোসলেম শরিফ)

 

প্রশ্ন: হুজুর, আমাদের আলেম সমাজ তকরির করতে গিয়ে এসব কথা বলেন না। কেবল হুর গেলমান আর দোজখের আগুনের কথা বলেন। আপনার কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, শরিয়ত এবং মারেফতের সার্থক সমন্বয়ই হচ্ছে মুক্তির পথ।

 

উত্তর: ঠিকতাই। হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরি (রহঃ) বলেছেন, কেবল শরিয়তে শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম মারেফতের আমল বিহনে ফাসিক। তাকে ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া বলা যাবে না। মিশকাত শরিফের শরাহ মিরকাত শরিফে বর্ণিত আছে যে, ইলমে মারেফত হাসিল না করলে পূর্ণ শরিয়ত আদায় হয় না। একটা ছাড়া অন্যটি অপূর্ণ এ কারণেই ইমাম মালেক (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কেবল ইলমে তাসাউফ আমল করিল কিন্তু ইলমে শরিয়ত আমল করিল না সে জিন্দিক (কাফের)। আর যে ব্যক্তি কেবল শরিয়তের আমল করিল কিন্তু তাসাউফের আমল করিল না ঐ ব্যক্তি ফাসেক। যে ব্যক্তি উভয়কে আমল করিল সে ব্যক্তিই সঠিক পথে আছে।

 

মনে রেখো, এক এক নবীর শরিয়ত এক এক প্রকার কিন্তু সকল নবীরই মারেফত এক রকম। শরিয়ত মানসুখ বা রহিত হয়, কিন্তু মারেফত কখনো মানসুখ হয় না। তা চিরকালই এক রকম থাকে। সুতরাং এ থেকেই আশা করি বুঝতে পারছো, কারা নাজাতপ্রাপ্ত দল হবে। তোমাদের ইলমে তরিকত ও ইলমে শরিয়ত হাসিল করার এবং আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আরও পড়ুন...

মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
প্রশ্ন: আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না, একথা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষ তার পাপের জন্য দোজখে যাবে কেন? ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ’। এ মারফতি গানটি তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।

সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব 

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন