মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
উত্তর: দেখুন, সীমা লংঘন কথাটা বোঝার আগে আমাকে বুঝতে হবে সীমা বলতে কি বোঝায়। সে সীমার অভ্যন্তরে কি আছে। সে সীমার রূপরেখা কি, তার সীমানাই বা কি। কুরআনুল করিমে মানুষের জীবন কেমন হলে আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তার একটা স্পষ্ট রূপরেখা আছে। আর তারই বাস্তব এবং মূর্ত প্রকাশ হচ্ছেন রাসূল পাক (সাঃ)। তাঁর সমগ্র জীবন, তাঁর শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য -সবই হচ্ছে একটি জিন্দা কুরআন। কুরআনের কোন উসুল বা নীতির ব্যত্যয় হয়নি তাঁর জীবনে। এজন্য হযরত আয়েশাকে ‘উসওয়ায়ে হাসানা’- সুন্দর চরিত্র বলতে কি বোঝায় প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন – ‘কেন আপনারা কি রাসূলের পাকের চরিত্র সম্পর্কে জানেন না?’ সুতরাং এ থেকে একথা স্পষ্ট যে আমাদের আদর্শের সীমানা, আমাদের সুন্দর জীবনের ঠিকানা রয়েছে রাসূলে পাকের ৬৩ বৎসরের জীবনে। আমরা সে সীমানার বাইরে পা ফেললে সীমা লংঘন করবো – আবার সীমানার মধ্যে যতখানি যাওয়ার কথা, স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ততটুকু না গেলেও সুন্নতের খেলাপ করবো। হুজুর পাকের জীবনচর্চার শেষ সীমানায় আমরা কেউই যেতে পারবো না। কিন্তু সে সীমানায় পৌঁছার অদম্য আগ্রহ থাকতে হবে। সেখানে যেতে পারবে না ভেবে নিজের ইচ্ছায় কোথাও থেমে, সেটাই পর্যাপ্ত ভাবলেও রাসূলের অনুগত্য করা হলো না। সূরা মায়েদার ৮৭ নং আয়াতটি লক্ষ্য করে দেখো- ‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানু লা তুহাররিমু তাইয়েবাতে মা আহাল্লাল্লাহু লাকুম ওয়ালা তা’তাদু’। অর্থাৎ ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ্ তোমাদের জন্য উৎকৃষ্ট যে সব বস্তু হালাল করেছেন সে সব বস্তুকে তোমরা হারাম করো না এবং সীমা লংঘন করো না।’
প্রশ্ন: কথাটা বুঝতে পারলাম না।
উত্তর: হুজুর পাক (সাঃ) যাকাত দেবার হুকুম করেছেন। হুজুর নিজে যাকাত দিতেন। আমরাও দেই। যাকাত নিতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষ মরছে প্রতি বছরই। কিন্তু হুজুর পাক রাতের অন্ধকারে যেতেন, যারা যাকাত পাবার হকদার তিনি এমনভাবে তাদের দিয়ে আসতেন যাতে অন্য কেউ টের না পায়। আমরা দৃশ্যত কুরআনের হুকুম পালন করছি। কিন্তু যেহেতু তা রাসূলে পাকের প্রদর্শিত পথে দান করা হলো না সে জন্য সে দানই বরবাদ হয়ে গেল। রাসূলে পাকের (সাঃ) সীমা লংঘন করা হলো বলে ব্যাপারটা হয়ে গেল রিয়া বা অহংকার -একটা লোক দেখানো দম্ভের প্রায়ন। তোমাদের কোরবানিও প্রায়শঃ এমনি একটা লোক দেখানো ব্যাপার।
কার গরু কত বেশি দামের, কিংবা কত বড় এ নিয়ে তোমাদের প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু একি রাসূল (সাঃ) অনুমোদিত কোরবানি হলো? রাসূলে পাক বলেছেন, তোমরা আমার মত নামাজ পড়ো। আমরা কি তাঁর মত নামাজ পড়ি? এক্ষেত্রেও আমরা সবাই নামাজ পড়ি, কিন্তু হয় সীমা লংঘন করি, না হয় সীমানা পর্যন্ত না গিয়ে নিজের মনগড়া দূরত্ব পর্যন্ত এগোই। ফলে সবটাই ধর্মের বিধি লংঘনের পর্যায়ে পড়ে। নামাজে আমাদের রুকু, সেজদা এবং একাগ্রতা কি তাঁর মত হয়?
প্রশ্ন: এই সীমার মাঝে থাকতে হলে কি করতে হবে?
উত্তর: বিদ্যা শিক্ষা না করলে তুমি সীমা কি তা-ই বুঝবে না। সেজন্য ইসলামে বিদ্যার্জনকে ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিদ্যাও আবার তিন রকমের, ইলমে কিতাব, ইলমে সিনা এবং ইলমে সফিনা। ইলমে কিতাব হচ্ছে শরীয়তের বিদ্যা যা অন্তরে পৌঁছায় না। মুখে মুখেই থাকে। এজন্য একে ইলমে লিসানও বলে। ইলমে সিনা হচ্ছে মারেফতের জ্ঞান যা ক্বালবে প্রবেশ করে। কিন্তু এ জ্ঞান কোন কিতাবে লেখা থাকে না। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে মুখে মুখে শিক্ষা দেয়া হয়। এ অনেকটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতিটি ঘরানার নিজস্ব রাজ বা গুপ্ত কিছু বিদ্যার মত যা কেবল শিষ্যকেই দেয়া হয়। আর ইলমে সফিনা হচ্ছে সে জ্ঞান যা শিক্ষার ব্যাপার নয়। ক্বাল্ব থেকে ক্বাল্বে স্থানান্তরের ব্যাপার। লেজার রশ্মি যেমন উৎস থেকে অন্য বস্তুতে গিয়ে তাকে একেবারে নিঃশেষে আত্মস্থ করে নেয় এ অনেকটা তেমনি। ঐ যে সূরা নূরে বলা হয়েছে ‘ইয়াহদিল্লাহু লিনুরিহি মাইয়াশাউ’ – ‘আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা পথ দেখান তাঁর জ্যোতির দিকে।’ আল্লাহ্র রহমত যাকে ছুঁয়ে যায় তাঁরই অন্তর আলোকিত হয় স্বর্গীয় জ্যোতিতে। ঐ জ্যোতি স্থানান্তরিত হয়ে ক্বালবে প্রবেশ করে। আর এমন ব্যক্তিই হন আল্লাহ্র ওলী বা বন্ধু।
প্রশ্ন: শরীয়তের বিদ্যাকে আপনি ইলমে লিসান বলেছেন। বলেছেন এ বিদ্যা ক্বালবে প্রবেশ করে না।
উত্তর: শরীয়ত যতক্ষণ তরিকতের সঙ্গে না মিশে ততক্ষণ বিদ্যা নিছক বিদ্যাই। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে কারবালার যুদ্ধ। সে যুদ্ধে এজিদের দলে সাত শত হাফেজে কুরআন ছিলেন। তারা যুদ্ধ করেছেন কার সঙ্গে? হুজুর পাক (সাঃ) কে আল্লাহ্ বলেছেন জিন্দা কুরআন। সুতরাং শরীয়তের বিদ্যা তরিকতের আলোকে তাদের ক্বালবকে আলোকিত করেনি বলেই তারা সে যুদ্ধকে জায়েজ মনে করেছেন। আসলে বিদ্যা বেশিরভাগ লোকেরই মুখে থাকে। এদের জীবন ব্যর্থ, এরা যতই সুন্দর বক্তৃতা করুক এদের জিন্দেগী হচ্ছে নাকাম বা অসফল।
প্রশ্ন: রাসূল পাকের কোন আদর্শগুলোকে আমরা সমকালীন জীবনে সবচেয়ে বেশি লংঘন করছি?
উত্তর : প্রথম কথা হলো আমরা সময়ের মূল্য দেই না। সময় অনুযায়ী কাজ করি না। কারো সঙ্গে কথা দিলে সময়মত উপস্থিত হই না। রাসূলে পাক (সঃ) জীবনে সময়কে যথাযথ সম্মান দিয়েছেন। একটি হাদিসে উল্লেখ আছে হুজুর পাক বলেছেন, যদি কোন মুমিন অন্য কোন মুমিনের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে সাক্ষাতের ওয়াদা করে এবং সময়মত হাজির না হয় তবে তার উপর খোদার লা’নত বর্ষিত হতে থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ সে ঐ মুমিনকে অপেক্ষায় রাখে। দ্বিতীয়তঃ আমরা নিজের কাজ নিজে করি না। অন্যকে আদেশ করি। রাসূলে পাক নিজের কাজ অন্যকে করতে দিতেন না। তাছাড়া নিজের স্ত্রীদেরও নানা কাজে সাহায্য করতেন। তৃতীয়ত: অসময়ে কারো সঙ্গে তিনি সাক্ষাত করতে যেতেন না। আমরা তাঁর এ সুন্নতগুলোকে লংঘন করছি খুব বেশি। বিশেষ করে সময়ানুবর্তিতা আমাদের নেই বললেই চলে। সময় বড় আশ্চর্য জিনিস। সময় চলে গেলে অনেক কিছুই বরবাদ হয়ে যায়। সময়ের আগে বা পরে ফরজ নামাজ হয় না। নির্দিষ্ট মাস ছাড়া হজ্ব হয় না। রমজানের বাইরে অন্য কোন মাসে ফরজ রোজা হয় না। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমিই সময়।’ এ সময়ের আদি নেই, অন্ত নেই। এমন যে সময় তার অমর্যাদা করছি বলেই আমাদের জীবনের বিপর্যয়ের শেষ নেই – সফলতা নেই। এ শিক্ষা আমাদের দেয়া হয়েছে পনের শত বছর আগে। দুঃখের বিষয় হলো সময়ানুবর্তিতার কথা বললে তোমরা ইংরেজদের উল্লেখ করো। মানুষ যখন আপন ইতিহাস বিস্মৃত হয় তখন এমনই হয়।
অতএব নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে জান এবং সেই মত জীবনকে গড়তে সচেষ্ট হও। তবেই দেখবে বিদ্যা হবে জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত, জ্ঞান হবে উপলব্ধির গৌরবে ভাস্কর আর সে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিই তোমাকে পৌঁছে দেবে তোমার আরাধ্যের কাছে।