মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
উত্তর: আমি সূরা ফাতেহা সম্পর্কে যা বলবো তা তাফসিরে মাজহারিতে আছে। সূরা ফাতেহার আর একটি নাম আছে। একে সূরা-তুস-সালাত ও বলে। এখানে সালাত মানে নামাজ হতে পারে, দরূদও হতে পারে। সূরা হিসাবে এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এই একটি সূরা সম্পূর্ণ নাজিল হয়েছে দু’বার – একবার মদিনায় এবং একবার মক্কায়। হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন রাসূল (সাঃ) এর সামনে যখন প্রথম জিবরাঈল (আঃ) হাজির হয়ে বললেন – ‘ইক্বরা’ (পড়) তখন রাসূল বললেন, ‘কি পড়বো?’। একথা শুনে জিবরাঈল মুহূর্তের জন্য অন্তর্ধান করলেন এবং ফিরে এলেন সূরা ফাতিহা নিয়ে। বললেন – আল্লাহর প্রশংসা এভাবে করুন। দ্বিতীয়বার একই সূরা সম্পূর্ণ অবস্থায় নাজিল হয় মদিনায় হিজরতের তৃতীয় দিন হযরত আবু আয়্যূব (রাঃ) এর ঘরে। এ সূরার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এই একমাত্র সূরা যা বিসমিল্লাহ সহ নাজিল হয়েছে। অন্যান্য সূরার সঙ্গে বিসমিল্লাহ নাজিল হয়নি। অনেকে বিসমিল্লাহকে এ সূরার অংশ মনে করেন – কেউ কেউ অবশ্য তা মেনে নেননি। যারা বিসমিল্লাহকে সূরা ফাতেহার অংশ মনে করেন তারা শেষ আয়াতটি শুরু করেন সিরাতাল্লাজিনা থেকে।
প্রশ্ন: হুজুর হামদ শব্দটি পদ হিসেবে বিশেষণ, অথচ এর আগে ডেফিনিট আরটিকেল (Definite Article) আল বসলো কেন? আল শব্দটি তো সাধারণত বিশেষ্যের আগে বসে?
উত্তর : ঠিকই বলেছেন। এও আরেক আশ্চর্য শব্দ-প্রয়োগ। এই একটিমাত্র বিশেষণ যার আগে আল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ডেফিনিট আর্টিকেল হিসাবে। আরবি ভাষায় মালিকানা অর্থেও আল শব্দটি ব্যবহৃত হয়, ইংরেজিতে যাকে তোমরা পজেসিভ কেইস (Possessive Case) বলো। হামদের মধ্যে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত তিনটি কালই আছে – সেজন্যে হামদ কোন ব্যক্তি বা বস্তুর বেলায় প্রযোজ্য নয়। হামদ কেবল আল্লাহরই হয়। রাসূলে পাক (সঃ) প্রশংসাকে আমরা ‘নাত’ বলি। ওলি-আল্লাহদের প্রশংসা অর্থে বলি ‘মানকাবাত’। আর সাধারণ মানুষের প্রশংসা অর্থে ‘মদহে সারাই’ বলি সে তো আগেই বলেছি।
প্রশ্ন: এ সূরা তো ‘কুল’ বা ‘হে নবী বলুন’ দিয়ে শুরু হয়নি। নবী (সাঃ) বা মানুষকে প্রশংসা করতে বলা হলে তাই বলা সঙ্গত ছিল না কি?
উত্তর: এখানে আল্লাহ নিজেই নিজের প্রশংসা করছেন। এখানে তাই তাঁর পরিচয় হলো তিনি মাহমুদ। তিনি যখন অন্যকে তাঁর প্রশংসা করতে বলেন তখন তিনি হন আহমদ। আল্লাহ যখন অরূপ থেকে রূপে প্রকাশিত হন তখন তাঁর নাম হয় মুহম্মদ। মাহমুদ এবং আহমদের মধ্যে যোগসূত্র হচ্ছেন মুহম্মদ। কিন্তু মাহমুদ, আহমদ, মুহম্মদ কোনটাই আল্লাহর নাম নয়। আল্লাহ শব্দটিও কোন নাম নয়। এজন্যই একজন ওলি-আল্লাহ বলেন – ‘বেইসমিহি মান্লা ইসমুহু’ – তার নামে শুরু করছি যার কোন নাম নেই। হযরত বড়পীর (রহঃ) বলেছেন – ‘মান আরাফাল্লাহা লা ইয়াক্কুলু আল্লাহ’। অর্থাৎ যারা আল্লাহকে চিনে তারা আল্লাহকে আল্লাহ বলে না।
প্রশ্ন: এ সূরার মর্তবা সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর: এ সূরার আয়াতের সংখ্যা হচ্ছে সাত। সাত একটি রহস্যময় সংখ্যা। সাতের কোন উৎপাদক নাই। সাতকে এক ছাড়া কোন সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না। সাতটি জান্নাত এবং সাতটি দোজখের কথা তো আমরা জানি। অন্যদিকে সপ্ত আসমানের কথাও কোরআনে বলা হয়েছে। এ সাতটি আয়াত ১৪ জন ফেরেশতা আছেন। এ ১৪ জন ফেরেশতা এ সূরার তেলাওয়াতকারীকে সাতটি আসমানি এবং সাতটি জমিনি আপদ থেকে রক্ষা করেন। এ সূরার অক্ষরের সংখ্যা হচ্ছে ১৪০টি। এর প্রতিটি অক্ষরের উপর একজন মোয়াক্কেল বা রক্ষক আছেন। তাদের কাজ হচ্ছে এ সূরার তেলাওয়াতকারীকে ১৪০ রকমের রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করা। এর প্রথম আয়াতের নাম হচ্ছে আয়াতুল হামদ। দ্বিতীয় আয়াতের নাম আয়াতে তাদাব্বুর। তৃতীয় আয়াতকে বলা হয় আয়াত একবার এবং অবশিষ্ট অংশ হচ্ছে আয়াতে দোয়া। ‘আমীন’ শব্দটি সূরা ফাতেহার অংশ নয়। এর মর্তবার কোন শেষ নেই। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত বোখারি শরিফের একটি হাদিস আছে, তাতে বলা হচ্ছে যে, সূরা ফাতেহা বা সূরাতুল হামদের ধর্মগ্রন্থেই নাজিল হয়নি। এক কথায় এ হচ্ছে সমগ্র কোরআনের নির্যাস। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের মূল কথা।
প্রশ্ন: সূরা ফাতিহা ছাড়া তো নামাজ হয় না। নামাজে সূরা ফাতেহা পড়া ওয়াজিব?
উত্তর: ঠিক বলেছো।
প্রশ্ন: ইমামের পেছনে যারা নামাজ পড়েন তারা তো সূরা ফাতেহা পড়েন না। তাহলে তাদের নামাজ হয় কি করে?
উত্তর: কেউ কেউ বলেন, মুক্তাদিরা সূরা ফাতেহা মনে মনে পড়বে। কিন্তু রাসূলে পাক (সঃ) বলেছেন, এক্ষেত্রে ইমাম সূরা ফাতেহা পড়লেই যথেষ্ট। রাসূলে পাক (সঃ) এ কথার সমর্থনে নাজিল হলো – ওয়া ইজা কুরিআল কোরআনু ফাসতামিউ লাহু ওয়া আনসিতু লা-আল্লাকুম তুরহামুন (সূরা আ’রাফ/২০৪)। অর্থাৎ যখন কেউ কোরআন পড়বে তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শুনবে, যাতে করে আল্লাহর রহমতের অধিকারী হতে পার। সুতরাং এ থেকেই বলা যায়, মুক্তাদিরা সূরা ফাতেহা শুনলেই হবে। মনে রেখো, নামাজের দুটো অংশ। একটি অংশ আল্লাহর জন্য, অন্যটি বান্দার জন্য। আল্লাহ বলেন- নামাজের অর্ধেক আমার, অর্ধেক আমার বান্দার। বান্দা যখন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বলে আল-হামদুলিল্লাহ – তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বলেন – ওহে ফেরেশতাগণ, দেখো আমার বান্দা আমার প্রশংসা করছে। আল্লাহ নিজে যখন তার কোন বান্দা বলে আর-রাহমানির রাহিম – তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন, ‘দেখ, দেখ, আমার বান্দা আমার গুণে গুণান্বিত হয়ে আমার প্রশংসা করছে।’ এমন নামাজকেই মেরাজুল মুমেনিন বলা হয়েছে। আল্লাহ তোমাদের সকলকে তাঁর মারেফাত নসিব করুন। আমীন।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন