মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আমরা প্রতি বছরই ঈদে মিলাদুন্নবী বা হুজুর পাক (সাঃ) এর জন্ম-উৎসব পালন করি। রবিউল আউয়াল মাস এলেই আমরা অধীর আগ্রহে এ শুভক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করি। হুজুর পাক (সাঃ) এর জন্ম-উৎসব প্রথম কখন পালন করা হয়?
উত্তর : রাসুলে পাক (সাঃ) এর জন্মের পর পরই তাঁর দাদাজান খাজা আবদুল মোত্তালিব খুব শান শওকতের সঙ্গে নাতির জন্ম-উৎসব পালন করেন। তাঁর পরিবারের লোকজন তো বটেই, পাড়াপড়শী সকলেই এ খুশিতে শরিক হয়েছিলেন। বৃদ্ধ আবদুল মোত্তালিবের বিশেষ খুশির কারণ ছিল। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র খাজা আবদুল্লাহ নাতির জন্মের আগেই এন্তেকাল করেন। নাতির মুখ দেখে খাজা আবদুল মোত্তালেব পুত্রশোক ভুলতে পেরেছিলেন। রাসুলে পাক (সাঃ)-এর জন্ম-উৎসব পালনের রেওয়াজ সেই শুরু। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের পর থেকে উৎসবটি একটি ভিন্ন মাত্রিকতা লাভ করে। কারণ আল্লাহতায়ালা আল-কুর’আনে বলেছেন, তোমরা যখন রহমত লাভ করবে তখন তোমরা আনন্দ করবে। আর রাসূলে পাক (সাঃ) সারা বিশ্বের জন্য রহমত “ওয়ামা আরসালনা-কা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আ’লামীন” অর্থাৎ তোমাকে আমি পাঠিয়েছি সারা ব্রহ্মান্ডের জন্য রহমত হিসাবে। সেজন্যে তাঁর পয়দায়েশ উপলক্ষে মুসলমান আনন্দে উদ্বেল হয়ে বলবে মারহাবা ইয়া রাসূলুল্লাহ মারহাবা, এটাই তো স্বাভাবিক।
প্রশ্ন: তিনি কি কেবল মুসলমানদের জন্য রহমত নাকি সমগ্র মানবতার জন্য। এ সম্পর্কে কুরআনে কোন স্পষ্ট উক্তি আছে কি?
উত্তর : হ্যাঁ আছে। সুরা নিসার ১৭৪ নং আয়াত লক্ষ্য করে দেখ। এরশাদ হচ্ছে, “ইয়া আইয়োহান্নাসু ক্বাদ জাআকুম বুরহানুম মির রাব্বিকুম ওয়া আনজালনা ইলাইকুম নুরাম মুবিনা” অর্থাৎ হে মানব সম্প্রদায় তোমাদের প্রভুর কাছ থেকে তোমাদের জন্য সনদ পৌঁছে গেছে আর আমি তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি একটি স্পষ্ট জ্যোতি। এখানে লক্ষ্য করলেই দেখবে, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মানব জাতিকে সম্বোধন করছেন। সুতরাং এ থেকেই স্পষ্ট যে আমাদের প্রিয় রাসুল (সাঃ) শুধু মুসলমানের জন্য নন, সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমত। তাছাড়া এ আয়াতটির শানে নুজুল লক্ষ্য করলে দেখবে যে এটি অবতীর্ণ হয়েছিল একটি বিশেষ অবস্থায়। রাসুলে পাক (সাঃ) সাহাবিদের যখন বলছিলেন, তোমরা আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়ে নাও। তখন একজন সাহাবি প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর রঙ কেমন? ঠিক এই মুহূর্তেই উপরোক্ত আয়াতটি নাজিল হয়েছিল। আয়াতটিতে “মির রাব্বিকুম” কথাটি লক্ষ্য করলেই দেখবে যে এ সনদ আল্লাহরই অস্তিত্বের অংশবিশেষ। আক্ষরিক অনুবাদে বলতে হয় এ বুরহান বা সনদ তোমাদের রব থেকে। আর তারপরই বলা হচ্ছে তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি একটি স্পষ্ট জ্যোতি।
ভুলে গেলে চলবে না আল্লাহ নিজেকে জ্যোতি বলে অভিহিত করেছেন, “আল্লাহু নুরুসসামাওয়াতি ওয়াল আরদ” (সুরা নূর/৩৫)। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, “আনা মিন নুরিল্লাহ ওয়া খালাকা কুল্লুহুম মিন নুরি” অর্থাৎ আমি আল্লাহর নূর থেকে এবং সমস্ত সৃষ্টি আমার নূর থেকে তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে সুরা মায়েদার ১৫ নং আয়াতটি মিলিয়ে পড়। এরশাদ হচ্ছে, “ক্বাদ জা’আকুম মিনাল্লাহে নুরু ওয়া কিতাবুম মুবিন” অর্থাৎ তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহ থেকে একটি নূর ও একটি স্পষ্ট গ্রন্থ। সুতরাং এ থেকেই রাসুলে পাক (সাঃ)-এর সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। তিনি মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন একথা ঠিক, কিন্তু তিনি আমাদের মত মানুষ ছিলেন একথা বলতে পারছি না। “আনা বাশারুম মিসলুকুম” আমি তোমাদের মতই মানুষ, আল্লাহ তাকে একথা বলার হুকুম করছেন এবং তিনি বলছেনও সেই কথা। কিন্তু শব্দটা হচ্ছে মিসলুকুম আসলুকুম নয়। মিসাল হচ্ছে রূপক, বাস্তব নয়। যা হোক, এ দেশের আলেমগণের অনেকেই তাকে আমাদের মতই মানুষ মনে করেন, শিরক হবে এই ভয়ে তার উপর দরুদ পাঠের সময় দাঁড়ায় না পর্যন্ত। কিন্তু এই আলেমদেরই আমি তাঁর পয়দায়েশ সম্পর্কে নিম্নলিখিত দলিলগুলি পাঠ করতে অনুরোধ করবো।
১. তলখিস (পৃ. ১১২০)
২. আত্তাহাসিলুল বয়ান (পৃ. ১৫২১)
৩. তফসিরে ওয়াহিদী
৪. উমদাতুন ফি কায়ফিয়াতে ওয়ালাদাতে রাসুল (পৃ. ১০২)
৫. জামেউল ফুসলায়েন
৬. হাশিয়াতুল আশফা (পৃ. ১৫২)।
এ কিতাবগুলিতে জন্মের শান অনুযায়ী মানুষকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ক) সাধারণ মানুষ, খ) আম্বিয়াকুল এবং গ) হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। বলা হয়েছে, সাধারণ জৈবিক নিয়মে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম হয়। কিন্তু আম্বিয়াগণ মায়ের নাভির সামান্য নিচে অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে পেট বিদীর্ণ করে পবিত্র অবস্থায় বের হয়ে আসেন। কিন্তু আমাদের রাসুলে পাক (সাঃ)-এর জন্ম সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হয়েছে। তিনি তাঁর মায়ের বাঁ দিকের পাছলি ফেটে বের হয়ে এসেছেন। রাসুলে পাক (সাঃ)-এর পয়দায়েশ সম্পর্কে তিন ধরনের মত প্রচলিত আছে, (এক) তিনি তাঁর মায়ের বাঁ দিকের পাছলি ফেটে বের হয়ে এসেছেন, এ মর্তের সমর্থনে ৩৫০ জন রমণী সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তারা হযরত আমেনার বাঁ দিকের পাছলিতে একটা কাটা দাগ দেখতে পেয়েছেন। (দুই) কেউ কেউ বলেন তিনি মায়ের নাভির সামান্য নিচের অংশ থেকে বের হয়ে এসেছেন। এবং (তিন) অন্যেরা এ দাবিও করেন যে, তাঁর জন্ম স্বাভাবিক মানবিক নিয়মেই হয়েছে। আমাদের রাসুলে পাক (সাঃ) সম্পর্কে এ তথ্যগুলো যে সব কিতাবে আলোচনা করা হয়েছে সেগুলো এদেশে পাওয়া যায় না, এর অধিকাংশই হয় আরবিতে না হয় উর্দূতে রচিত।
আমাদের নবি (সাঃ)-কে আমরা মানবিকতার নিরীখে দেখতে দেখতে তাঁকে আমাদের মতই মানুষ বানিয়ে ফেলেছি। তিনি মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের মত মানুষ ছিলেন না। এ কথা বলতে আবার আলেম সমাজ শিরক এর ভয়ে অস্থির। তারা এমনই ভীত যে দরুদ শরিফ পাঠের সময় কেয়াম করাটাকেও তারা শিরক মনে করেন। অথচ দাঁড়িয়ে সম্মান করার শিক্ষা আমরা আমাদের রাসুলে পাক (সাঃ)-এর কাছ থেকেই পেয়েছি। আমাদের প্রিয় নবী (সঃ) তার কন্যা হযরত ফাতেমাকে দেখলে উঠে দাড়াতেন, নিজের স্ত্রী হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) এলে উঠে দাঁড়াতেন। মিলাদ মাহফিলে রাসুলে পাক (সাঃ)-এর শানে উঠে দাঁড়ালে কোন ধরনের শিরক হয় আমি সত্যিই বুঝতে পারি না। মনে রেখ, ‘মুহাম্মদ’ কোন নাম নয়, মুহাম্মদ একটি শান যা অনন্য। আল্লাহ যেমন অনন্য, মুহাম্মদ (সাঃ) ও তেমনি অনন্য। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছো যে আমার মত? (বোখারি) আল্লাহ্ নামটির চারটি অক্ষর দিয়ে যেমন চারটি নাম হয়- আল্লাহ্, লিল্লাহ, লাহু, হু, তেমনি ‘মুহাম্মদ’ নামের চারটি অক্ষর দিয়েও চারটি নাম হয়, মুহিও, হাইয়ু, মুমিতু এবং দাইয়ু। কিন্তু মনে রাখতে হবে সৃষ্টির এই বিপুল প্রকাশে মুহম্মদ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, কিন্তু অব্যক্তের পরিমন্ডলে তিনি কি তা কেবল খোদাই জানেন। এজন্যেই কবি আকবর এলাহবাদী বলেন-
মুহাম্মদ সিররে ওয়াহদাহ হ্যায় –
[মুহম্মদ একত্বের রহস্য
কোই রমজ ইস কা কেয়া জানে –
এ রহস্যের ভেদ কে জানে
শরিয়ত মে তো বান্দা হ্যায় –
শরিয়তে বান্দা বটে
হাকিকত মে খোদা জানে। –
হাকিকতে কি তা খোদাই জানে।]
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন