Mobile Menu

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)

শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন

প্রশ্নোত্তর পর্ব

(১২)

এবাদতের সাপ এবং দরুদের ছায়া

প্রশ্ন: সম্প্রতি ইসরাইলে রাসূলে পাক (সাঃ) এর যে অবমাননা করা হয়েছে তা সারা বিশ্বের মুসলমানদের গভীরভাবে আহত করেছে। সকলেই এর নিন্দা করেছে?

 

উত্তর : এটাই স্বাভাবিক। বিধর্মীদের এ ধরনের পাশবিক আচরণে আমরা আহত হই, ক্ষুদ্ধ হই ঠিকই। কিন্তু নিজেরা যখন রাসুলের অবমাননা করি, তখন কিন্তু নিজেদের আচরণের দিকে একবারও ফিরে তাকাই না। এই যেমন ধরো, কেউ যখন মুসলমানের মসজিদ ভাঙে তখন মুসলমান তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, রুখে দাঁড়ায়-কিন্তু মসজিদ থাকতে সেই মুসলমান যখন মসজিদে যায় না সেটা মসজিদ ভাঙার মতই একটা গর্হিত অপরাধ। আমি বলবো সেটা মসজিদ ভাঙার চেয়েও বড় অপরাধ। কিন্তু মুসলমান সেদিকে ফিরেও তাকায় না। আত্মসমালোচনা করে না-আত্মশুদ্ধির দিকে এগোয় না। রাসুলে পাক (সাঃ)-এর অবমাননা করা হয় মুসলমানের দ্বারাই – সে কথা একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।

 

প্রশ্ন: মুসলমান রাসুলে পাক (সাঃ)-এর অবমাননা করে কথাটা ঠিক বুঝলাম না?

 

উত্তর: যে ব্যক্তির যতটা সম্মান প্রাপ্য ততটা সম্মান তাকে না দিলে তার অবমাননা হয়, একথা মান?

 

প্রশ্ন: সে তো ঠিকই?

 

উত্তর: তাহলে তোমাকে এখন বুঝতে হবে, অন্তত বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে তোমার রাসুলে পাক (সাঃ)- এর সঠিক মর্যাদা কি? সুরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতটির দিকে লক্ষ্য কর এরশাদ হচ্ছে : ‘ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লু না আ’লান্নাবি ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহে ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা’ অর্থাৎ আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাম প্রেরণ করেন, হে মুসলমানগণ তোমরাও নবীর জন্য রহমত প্রার্থনা কর এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও। এখানে লক্ষ্যণীয় যে সালাত শব্দটি আল্লাহ, ফেরেশতা এবং মানুষের বেলায় প্রযোজ্য হলে এর অর্থ ভিন্ন ভিন্ন হয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে এর অর্থ হয় রহমত, ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে এর অর্থ হয় দরুদ এবং মানুষের ক্ষেত্রে এর অর্থ হয় নামাজ। আমাদের রাসুলে পাক (সাঃ)-এর মর্যাদা কত উঁচুতে এ থেকেই তা আন্দাজ করা যায়। মানুষ দরুদ পেশ করবে সরাসরি তাঁর কাছে নয় – আল্লাহর মাধ্যমে। তিনি এতই পবিত্র যে মানুষের নাপাক মুখের দরুদ সরাসরি পেশ করা যাবেনা, পেশ করতে হবে আল্লাহ্র মাধ্যমে – বলতে হবে ‘আল্লাহুমা সাল্লে আ’লা…’ হে আল্লাহ তুমি আমাদের সালাম পৌঁছে দাও তোমার হাবিবের দরবারে। মনে রাখতে হবে ‘আল্লাহুমা’ শব্দটি থাকলেই সেটা দরুদ হবে – তা না থাকলে সেটা

 

হবে সালাম। লক্ষ্য করে দেখ, উল্লেখিত আয়াতটিতে শেষ দুটি শব্দ হচ্ছে ‘সাল্লিমু তসলিমা’। ‘সাল্লিমু’ শব্দটি দিয়েই আয়াতটি শেষ হতে পারতো – কিন্তু তসলিমা শব্দটি যোগ করে সালামের মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে – অর্থাৎ সালাম জানাও যথাযোগ্য মর্যদায়।

 

সুতরাং দরুদ শরিফের প্রকৃত অর্থ উপলদ্ধি করতে হবে। তোমরা হয়তো জান না উল্লেখিত আয়াতটি নাজিল হয়েছিল রবিউল আউয়ালের ৪ তারিখ – শুক্রবারে। ভুলে যেও না হুজুর পাক (সাঃ)-এর আগমন হয়েছিল রবিউল আউয়াল মাসে এবং তিনি হযরত আমেনার গর্ভে এসেছিলেন শুক্রবার দিন জুমা’র আযানের সময়। শুক্রবার হচ্ছে একমাত্র দিন যার উল্লেখ কুর’আন শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা জুমুআ’র ১০ নং আয়াতটিতে বলা হয়েছে- “ওয়া ইজা কুদিয়াতিস সালাতু ফানতাশিরু ফিল আরদি ওয়াবতাগু মিন ফাদলিল্লাহি ওয়াজকুরুল্লাহা কাসিরাল্ লা’য়াল্লাকুম তুফলিহুন” – অর্থাৎ সালাত শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।

 

এ আয়াতটি হুজুর পাক (সাঃ) পড়ার পর হযরত মা’স বিন জাবের (রাঃ) প্রশ্ন করেছিলেন – হুজুর কোন জিকরটি করবো?

 

ঠিক এ সময়েই আল্লাহর ওহী এল এবং  নাজিল হলো সুরা আহযাবের ১০ নং আয়াতটি যার কথা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং নামাজের শেষে যে জিকরের কথা বলা হয়েছে সেটা এই দরুদ শরিফ।

 

প্রশ্ন: আমাদের দেশে দরুদ পড়ার সময় কেয়াম করা না করা নিয়ে একটা মতভেদ আছে?

 

উত্তর: হ্যাঁ আছে। তবে যারা বলে রাসূলে পাক (সঃ)-এর সম্মানে দাঁড়ালে শিরক হবে তাদের জন্য করুণা হয়। হুজুরে পাক (সঃ)-এর  জীবনীর দিকেই তাকিয়ে দেখ না, একবার খালিদ বিন ওয়ালিদ যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলেন। হুজুর বললেন – ‘তুয়াজ্জেরু ওয়া তুয়াজ্জিমু’ – সম্মান কর, তাজিম কর।

 

একজন সাহাবি বললেন – হুজুর, কি ভাবে?

 

হুজুর পাক (সাঃ) বললেন – কুমু ইলা সাইয়্যেদিকুম – তোমাদের নেতার জন্য দাঁড়িয়ে যাও। এ থেকে কি এ কথা প্রমাণিত হয় না যে রাসুলে পাক (সাঃ) সম্মান দেখানোর পন্থা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাওয়াকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। তাছাড়া তিনি তো হায়াতুন্নবি, চিরঞ্জীব নবি। সুতরাং দাঁড়িয়ে দরুদ পড়লে শিরক হবে এ রকম যুক্তিও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

 

ভুলে যেও না, যারা রাসুলে পাক (সাঃ)-এর প্রকৃত মর্যাদা সর্ম্পকে অবহিত তারা কিন্তু দাঁড়ানোটাকেই ফরজ মনে করেন। মওলানা রূমীর মসনবি শরিফের মধ্যে যতবার ‘মুহম্মদ’ (সাঃ) নামটি এসেছে – লিখবার সময় ততবারই তিনি নামটি লিখেছেন দণ্ডায়মান অবস্থায়। এবার কয়েকটি হাদিস বলি শোন। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন – তোমরা উজ্জ্বল রাতে এবং উজ্জ্বল দিনে দরুদ শরিফ পাঠ করবে। কারণ আমি নিজে তোমাদের দরুদ শুনে থাকি। এ থেকেই প্রমাণিত হয় তিনি হায়াতুন্নবি। এখানে উজ্জ্বল রাত হচ্ছে জুম’আর রাত এবং উজ্জ্বল দিন হচ্ছে জুমা’।

অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, যারা এই রাতে (জুমে রাত) ১০০ বার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাদের ৭০টি দুনিয়ার এবং ৩০টি আখেরাতের চাহিদা পূরণ করবেন।

 

আর একটি হাদিসে আছে যারা জুমার দিন আমার উপরে দরুদ পাঠ করবে তাদের ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। অন্যত্র উল্লেখ আছে যারা জুমেরাতের দিন দরুদ পাঠ করবে তারা দরিদ্র হবে না পরমুখাপেক্ষী হবে না।

 

এবার সুরা আহযাবের ৫৭ নং আয়াতটির দিকে তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। এরশাদ হচ্ছে – “ইন্নাল্লাজিনা ইউজুনাল্লাহা ওয়া রাসুলাহু লা’য়ানাহুমূল্লাহু ফিদ্দুনইয়া ওয়াল আখিরাতি ওয়া আ’য়াদ্দালাহুম আজাবাম মুহিনা” – অর্থাৎ যারা আল্লাহ এবং রাসুলকে কষ্ট দেয় আল্লাহ তাদের দুনিয়া এবং আখিরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

 

যে আয়াতে মানুষকে রাসুলের প্রতি দরুদ পেশ করার কথা বলা হয়েছে সে আয়াতের ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহু এবং রাসুলকে কষ্ট দিলে তাদের দুনিয়া এবং আখিরাত দুই বরবাদ হয়ে যাবার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং রাসুলে পাক (সাঃ)-এর যথাযোগ্য সম্মান করতে যারা কুন্ঠিত তাদের নিজেদের বিদ্যার অহঙ্কার সম্পর্কে সজাগ হবার প্রয়োজন আছে। যাদের মনে রাসুলে পাক (সাঃ)-এর প্রতি মুহব্বত নেই – তাদের এবাদত লোক দেখানো এবাদত। রাসুলে পাক (সাঃ)-এর মুহব্বত ছাড়া কোন এবাদতই কবুল হবে না। এ কথা কোরআনই বার বার বলেছে।

 

আর একটি হাদিস বলে শেষ করি। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, সপ্তাহের শ্রেষ্ঠতম দিন হচ্ছে জুমা’। এ দিন কেয়ামত হবে এবং তখন সব কিছু স্থির হয়ে যাবে। এ আযাব যখন আসবে তখন তার হাত থেকে কারো রক্ষা নেই। যার যার কৃতকর্ম তার তার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তোমাদের লোক দেখানো এবাদত সেদিন সাপ হয়ে তোমাদের দংশন করবে। আর যারা জুমা’র দিনে দরুদ পড়েছিল সে দরুদ তাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে বিরাজ করবে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আরও পড়ুন...

মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
প্রশ্ন: আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না, একথা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষ তার পাপের জন্য দোজখে যাবে কেন? ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ’। এ মারফতি গানটি তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।
প্রশ্ন: বর্তমান বিশ্বে ইসলামের একটা পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখুন না, কত লোক নামাজি হচ্ছে। জুমার নামাজে মসজিদে ঠাঁই হয় না?

সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব 

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন