মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: হুজুর, আমাদের সমকালীন সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি বলে মনে হয় আপনার কাছে?
উত্তর: আমি তো ভিনদেশী মানুষ, বত্রিশ বছর এদেশে আছি। এদেশের নাগরিক হয়ে গেছি। কিন্তু আসলে তো আমি ভারতের উত্তর প্রদেশের লোক। আমার ভাষাও ভিন্ন ছিল। এখন না হয় তোমাদের সঙ্গে থেকে কিছু বাংলা বলা শিখেছি। আমি কি করে বলবো তোমাদের সমস্যার কথা।
প্রশ্ন: হুজুর আপনি এখন মনে প্রাণে ভাষায় একজন খাঁটি বাঙালি। তবু আপনি বাইরে থেকে এসেছেন বলে আমাদের দোষগুলো আপনার চোখেই সহজে পড়ার কথা।
উত্তর: তোমাদের সাধারণ মানুষ খুবই ধর্মভীরু। আলেম সমাজকে শ্রদ্ধাভক্তি করে। ধর্মের কথা মনযোগ দিয়ে শোনে। আল্লাহ রাসূলের কথা শুনলে কেঁদে বুক ভাসায়। আসলে গন্ডগোল তো আমাদের মতো আলেমদের মধ্যে। আমরা রাসুলে পাক (সঃ)-কে এদের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। আমার নানাজান হযরত শাহ কারামত আলী জৌনপুরি (রহঃ) প্রায় দেড়শ বছর আগে এদেশে এসেছিলেন। তখন এদেশের মানুষ ইসলামকে প্রায় ভুলতেই বসেছিলো। তিনি বজরায় করে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলা এবং আসামে। মানুষকে আবার সেই পথে আহবান করেছেন যে পথ ছিল রাসুলে পাক (সঃ)-এর। মানুষ তার কথা প্রাণভরে শুনেছে। তাকে গ্রহণ করেছে অন্তর দিয়ে। আজ এদেশে ইসলামের যে প্রদীপ জ্বলছে তার মূলে নানাজানের অবদান অনেক। নানাজান এদেশের মানুষকে ভালবেসেছিলেন। এদেশেই শেষ পর্যন্ত থেকে গেলেন। রংপুরে তার মাজার শরীফ রয়েছে। দেখবে তার মাজারে কোন নজর নেয়াজ দেওয়া মানা, সেজদা করা মানা এবং আরো দেখবে তার কবরের উপরের দিকটা বাঁধানো নয়। শরিয়ত সম্মত নয় এমন কোন কাজই সেখানে হয় না।
প্রশ্ন: হুজুর আমার প্রশ্নের উত্তর?
উত্তর: না ভুলে যাইনি। ওলী আল্লাহর কবর যেয়ারত করায় কোন মানা নেই, কিন্তু মাজার পুরস্তি বা মাজার পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ। এই কথাটা তোমরা সবাই জান কিন্তু এ সমাজে সর্বত্র দেখবে কথাটা অমান্য করা হচ্ছে। তোমার প্রশ্নের উত্তরও এখানেই আছে। তোমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় গলদ হচ্ছে জানা এবং মানার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। জানা যদি জমীন হয়, তবে মানা হবে আসমান। আসমান জমীনের ফারাক দুর্লঙ্ঘ্য তেমনি তোমাদের জানার সঙ্গে মানার পার্থক্য বিরাট।
প্রশ্ন: হুজুর একটু বুঝিয়ে বলুন।
উত্তর: কেন, সবাই জানে জুয়া খেলা হারাম। কিন্তু তোমার সরকার লটারির নামে জুয়াকে অনুমোদন করেছে। মদ খাওয়া হারাম কে না জানে। কিন্তু‘ তোমাদের অনেকের মধ্যে মদ খাওয়াটা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। অবৈধ যৌন সম্ভোগ মহাপাপ, সবাই জানে, কিন্তু ঐ জানা পর্যন্তই। ঘুষ খাওয়া হারাম, কিন্তু নজরানার নামে ঘুষ চলছে সমাজের সর্বত্র। অথচ এরা সবাই ইসলামের কথা বলেন, যার মানার বা আমল করার প্রয়াস যত কম, তার ইসলাম সম্পর্কে বক্তৃতা তত বেশি জোরালো। তোমাদের শেখ মুজিব অন্তত দুটো কাজ করেছিলে, ঢাকায় রেস খেলা (জুয়া) বন্ধ করেছিলেন এবং মদ বন্ধ করেছিলেন। এখন তো তোমাদের দেশে মদ জুয়া দুটোই অপ্রতিহত গতিতে চলছে। শুধু ধর্ম কেন আইনের বেলায়ও দেখ না। আইন আছে, কেউ মানে না। গাড়ির কালো ধোঁয়া বেআইনী, দেখবে সরকারী প্রতিষ্ঠানের বাসে গাড়িতে ধোঁয়া সবচেয়ে বেশি। বিআরটিসির বাসগুলো দেখলেই বুঝতে পারবে। বাসে সিগারেট ফুকা বেআইনী কিন্তু বলে দেখ, তোমাকে তেড়ে আসবে মারতে। সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়, জানি কিন্তু মানি না। সুতরাং এ সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জানা এবং মানাকে একসূত্রে গাঁথতে না পারা। ফলে তোমাদের সমাজে নিত্য নতুন মসজিদ হচ্ছে, নামাজীর সংখ্যা বাড়ছে কিš‘ নামাজ নেই কোথাও।
প্রশ্ন: হুজুর, ধর্ম তো অনেক বিরাট জিনিষ। এত কথা শোনার সময় কোথায় দুরন্ত ঘূর্ণির মতো ছুটছে মানুষ। আপনি কি খুব সংক্ষেপে কিছু বলতে পারেন যাতে আমাদের এ মানসিকতার পরিবর্তন আসে।
উত্তর: আমি বললে কি আর আমার কথা শুনবে। তবে রাসুলে পাক (সঃ)-এর একটা ঘটনা শোন। একদিন একটা লোক এসে বললো, হুজুর আপনি আমাকে নসিহত করুন। কিন্তু বেশি কিছু নয়, খুব সংক্ষেপে এমন কিছু বলুন যাতে জীবনের আমূল পরিবর্তন আসে। হুজুর পাক (সাঃ) লোকটিকে তিনটি কথা বলেছিলেন: যখন তুমি নামাজে দাঁড়াবে, তখন মনে করবে এইটাই তোমার জীবনের শেষ নামাজ; যখন কথা বলবে তখন খুব বুঝে শুনে মেপে কথা বলবে এবং আল্লাহ তোমাকে যে ধনদৌলত দিয়েছেন তার জন্যে শোকর গোজারি করবে।
প্রশ্ন: এই সামান্য তিনটা কথা কেমন করে একজনের জীবনকে বদলে দিতে পারে?
উত্তর: যে নামাজে দাঁড়িয়ে ভাববে, এইটেই তার জীবনের শেষ নামাজ, তার পক্ষে কোন অন্যায় কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ ঐ লোকটির মনে মৃত্যুর ভয় থাকবে সব সময়। আর যার মৃত্যুর ভয় আছে তাকে কোন পাপ স্পর্শ করতে পারে না। এজন্যেই হুজুর পাক (সাঃ) দৈনিক অন্তত একবার মৃত্যুকে স্মরণ করার কথা বলেছেন। মৃত্যুকে যে মনে রাখবে আল্লাহর কথাও তার মনে থাকবে।
দ্বিতীয় কথা হলো বাক সংযম। আমাদের জীবনে আমরা কথা বলতে জানি না বলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের এবং অন্যের বিপদের কারণ হই। এজন্যে হুজুর পাক (সাঃ) অন্যত্র বলেছেন যার হাত এবং মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ নয়, সে মুমিন নয়। তোমাদের শেক্সপিয়রও শুনেছি বাক সংযমের কথা বলেছেন মোট কথা তুমি এমন কিছু বলবে না যার জন্যে কেয়ামতে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। আর তৃতীয় কথা হচ্ছে শোকর। শুধু ধনদৌলত কেন, তোমার এ জীবনের জন্যেও। তোমাকে বলতে হবে, সব প্রশংসা তার। যে শোকর করে তার মধ্যে সবর আছে। যার সবর নেই সে কখনও শোকর করতে পারে না। আর মুমিনের ঈমান হচ্ছে শোকর এবং সবরের মধ্যে।
এখন বল, যাকে তুমি সামান্য বলবে তা কি সত্যি সামান্য, নাকি অনেক বড় জিনিস। আর এ তিনটি জিনিস আমল করলে দেখবে জীবন বদলে গেছে। দেখ, ধর্মের একটা জিনিস অন্যটার সঙ্গে গাঁথা। একটা আমল করবে, অন্যটা করবে না, তা হয় না। নামাজ যদি সত্যি পড়, তাহলে তুমি মিথ্যা বলতে পারবে না, কোন পাপ করতে পারবে না। কিন্তু তবু আমরা মানুষ, পাপ আমরা করবো এটা তো তাঁর জানাই আছে। আমাদের পাপের চেয়ে তার ক্ষমা করার ক্ষমতা অনেক বেশি। ক্ষমা চাইতে হবে তাঁর দয়া পাবার শর্তই হচ্ছে ওটা। যার মধ্যে তওবা, এনাবাত ও নাদামাত নেই তার এবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। তওবা হচ্ছে কোন কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার অঙ্গীকার করা, এনাবাত হচ্ছে লজ্জিত হওয়া এবং নাদামাত হচ্ছে অনুতপ্ত হওয়া। এ তিনটি জিনিষ ছাড়া কেউ তার দয়া লাভের যোগ্য হয় না, হতে পারে না।
শুধু জানলে, টেলিভিশনে সভা সমিতিতে বক্তৃতা করা যায়, মানতে না পারলে আল্লাহর কাছে মকবুল গ্রহণযোগ্য হতে পারবে না কেউ।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন