Mobile Menu

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)

শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন

প্রশ্নোত্তর পর্ব

(১)

প্রারম্ভ

মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা নিম্নে দেওয়া হল-

ফুরফুরা শরীফের মোজাদ্দেদে জামান আলা হযরত পীর আবুবকর সিদ্দিকী (রহঃ) যে নীতি ও মতবাদ মানতেন ও বলেছেন, তা কোরআন হাদিস ইজমা কেয়াস শরা শরীয়ত অনুযায়ী নির্ভেজাল ও সঠিক। আমরা ফুরফুরা শরীফের দাদা পীর কেবলা (রহঃ) এর সেই নীতির অনুসারী ও সিলসিলার অন্তর্ভুক্ত। এই নীতিকে অনুসরণ করে যারা ফুরফুরা শরীফে আসেন, তাদের শরা-শরীয়ত সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করা ও বিশ্বাসকে মজবুত করা এবং এলমে তাসাউফ শিক্ষা লাভ করে নিজের আত্মিক উন্নতি ঘটানো উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেব ছিলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ, তার পদাঙ্ক অনুসরণে বর্তমানের পীর সাহেবগণও কোন রাজনীতি করেন না এবং কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও নন। দেশ ও দশের কল্যাণে শান্তি শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রশাসনকে তারা সমর্থন করেন। হযরত নবী করিম (সঃ) এর সাহাবায়ে কেরাম বা অনুচরবর্গের সময়ে রাজনীতি ছিল শরা শরীয়ত অনুসারী রহমানী রাজনীতি, যা ছিল মানব কল্যাণ ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে। কিন্তু বর্তমান রাজনীতির পঙ্কিলতা ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য ও বিশেষ গোষ্ঠির স্বার্থরক্ষার জন্য ভয়াল রূপ ধারন করেছে। অতএব এ রকম কোন গোষ্ঠি বা রাজনৈতিক দলের কোন আহ্বানে সত্যিকারের আল্লাহর ওলি পীরে কামেলগণ সাড়া দিতে পারেন না। ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেবগণও অনুরূপ ডাকে সাড়া দেন না।

বর্তমান শরা শরীয়তের প্রশ্ন তুলে একদল প্রচ্ছন্ন রাজনীতি করছেন। তারা ইসলামের জিগির তুলে মানুষকে এমনভাবে ডাক দিচ্ছেন, তাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেবগণ কখনও এ জাতীয় স্বার্থসিদ্ধিমূলক আহবান জানান না এবং এ জাতীয় ডাকে সাড়াও দেন না। কারণ এমন কিছু রাজনৈতিক দল ও সংস্থা আছে যারা লোক দেখানো ইসলামী দলদের আড়ালে নিজেদের আখের গুছানোর সুযোগ খুঁজছেন। সেই সঙ্গে তারা, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, জাতীয় সংহতি ও শান্তি শৃঙ্খলাকে নষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত আছে।

তাই ফুরফুরা শরীফের ভক্ত মুরিদও সাধারণ মানুষের নিকট আবেদন, এ ধরণের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে সকল প্রকার হটকারিতা দূর করে শান্তি শৃঙ্খলার সঙ্গে নিজ নিজ ধর্ম পালনের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করতে সচেষ্ট থাকবেন।

সুলতানুল আরেফীন হযরত ন’হুজুর পীর কেবলা (রহঃ) এর ইন্তেকালের পর জানাজার জন্য লোকজন সমবেত হয়। সে সময় আলেম ওলামাগন তাকে কিছু প্রশ্ন করতে থাকেন- “আপনারা কোন প্রকার বিভ্রান্ত হবেন না। সবর (ধৈর্য্য) এখতেয়ার করুন। হুজুর কেবলার নির্দেশ দাদা পীর কেবলার নীতির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন। নিজেদের মধ্যে এত্তেফাক (একতা) কায়েম রেখে সিলসিলার যাতে কোনরূপ ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেভাবে এতদিন হুজুর কেবলার নির্দেশ মোতাবেক সকল কাজ চলে আসছে সেভাবেই চলবে। তার একচুল এদিক ওদিক করা চলবে না। কোন প্রকার সমস্যা দেখা দিলে আমরা নিজেরাই তার নির্দেশানুযায়ী ফয়সালা করে নেব। মুরিদ মোর্তাকেদ, আলেম ওলামা, বিশেষ করে আমার আব্বার খলিফাগনকে এদিকে গভীর ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।”

তোমরা নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করবে। কোন বিষয়ে মোনমালিন্য দেখা দিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে ফেলবে। মানুষের মধ্যে রাগ অতি ক্ষতিকারক বস্তু। নারী পুরুষ সকলকে লক্ষ্য করে বলছি, তোমরা রাগকে হজম করার চেষ্টা কর, যে ব্যক্তি একটা হাতিকে ফেলে দিতে পারে আমরা তাকে বড় পাহালওয়ান বলে থাকি, কিন্তু জেনে রেখো ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বড় পাহালওয়ান যে নিজের রাগকে হজম করতে পেরেছে। কেননা রাগের দ্বারা মানুষ নানাবিধ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া রাগ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, ইসলামিক সর্বদিক দিয়েই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ পাক কোরআন শরীফে ঘোষনা করেন। “তোমরা রাগকে হজম কর ও মানুষদেরকে ক্ষমা কর।” এই রাগ হজম করা ও মানুষকে ক্ষমা করা কত বড় যে মহৎ পূর্ণ তা আল্লাহ পাকই জানেন। তোমরা বিপদে ধৈর্য্য ধারণ করবে। অনেকে অধৈর্য্য হয়ে আল্লাহ পাকের উপর নানারূপ দোষারোপ করে থাকে। তারা জানেন না, বিপদ আপদ আল্লাহ পাকের হুকুমে এসে থাকে এবং এর মধ্যে সেই ব্যক্তির জন্য উত্তম জিনিষ নিহিত আছে। কোরআন শরীফে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন,

তুমি যে বিপদে পতিত হয়েছে তার উপর ধৈর্য্য ধারণ কর তাহলে তোমাকে উত্তম প্রতিদান দেওয়া হবে। সেই উত্তম প্রতিদান হল ‘ইন্নাল্লাহা মায়াস সাবেরীন’ অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ পাক ধৈর্য ধারণ কারীদের সঙ্গে থাকবেন। তিনি কত বড় ভাগ্যবান যার সঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ পাক আছেন। তবে সবরের ও ভাগ আছে, একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আর একজন দূর্বল, দুই ব্যক্তির মধ্যে যদি বিবাদ হয় দুর্বল ব্যক্তির প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় সে সবর করল,

আর শক্তিশালী ব্যক্তির প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে সবর করল, এই দুই ব্যক্তির সবর কিন্তু এক পর্যায়ের হবে না। শক্তিশালী ব্যক্তি নিজের রাগকে হজম করে আল্লাহর হুকুমকে শিরোধার্য করে সবর এখতেয়ার করল। এই সবরের মূল্য অনেক বেশী। এই ধরণের ধৈর্য্য ধারণকারীদের আল্লাহ পাক সাবেরীনের মাকাম এনায়েত করে থাকেন।

আপনি যদি কোন ইনস্টিটিউশনে অ্যাডমিশন নেওয়ার ইচ্ছা করেন প্রথমে সেই প্রতিষ্ঠানের আইনশৃঙ্খলা পছন্দীয় কিনা দেখার পর ভর্তির আবেদন ফ্রম পূরণ করে অ্যাডমিশন নিয়ে থাকেন, এর অর্থ হল, ইনস্টিটিউশনে নিয়ম কানুন সম্পূর্ণরূপে মান্য করার স্বীকৃতি দেওয়া। উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে কোন শিক্ষক যদি অন্যত্রে চলে যায় তাহলে তার পিছে পিছে কোন ছাত্রের প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে যাওয়া উচিৎ হবে না। কেন না আপনি কোন শিক্ষককের নীতিকে সমর্থন জানিয়ে ভর্তি হন নি।

তদ্রুপ ফুরফুরা শরীফের সিলসিলা মানে একটা ইনস্টিটিউশন। আমরা এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, যেকোন শিক্ষকের মাধ্যমে আপনি যদি এই নীতিকে সমর্থন করে বায়াত হয়ে থাকেন, তাহলে আর এদিক-ওদিক করা চলবে না। যদি আমি বাকী বিল্লাহ দাদা পীর কেবলার নীতিকে ত্যাগ করে অন্য কোন নীতি বা দলের সঙ্গে হাত মেলাই, তাহলে তোমরা কি দাদা পীর কেবলার নীতিকে ত্যাগ করে আমার পিছনে দৌড়াবে? না এটা উচিৎ হবে? বরং যে নীতিকে সমর্থন করে বায়াত হয়েছিলে তার উপরেই মজবুতির সঙ্গে কায়েম থাকতে হবে।

হাকিম মানব হুকুম মানব না, এ হাকিম মানা হয় না। আল্লাহ পাক হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করে সকল জ্বিন ও ফেরেস্তাদের সেজদা করার নির্দেশ দিলেন। সকলে আল্লাহ পাকের হুকুমকে মান্য করল, কিন্তু ইবলিস অমান্য করায় আল্লাহ পাকের অভিসম্পাতে পতিত হল।

বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি হুকুম হল, তোমরা কাবা শরীফের দিকে, মোতাওয়াজ্জুহ হয়ে নামাজ আদায় কর। কেউ যদি ভাবে, কাবা শরীফ কেবলমাত্র একটা পাথরের ঘর, আল্লাহ পাক সর্বস্থানে বিরাজমান, অতএব যে দিকে ইচ্ছা মুখ করে নামাজ পড়লে দোষ কি? আমি বলি আল্লাহকে মানলে তার হুকুমকে মানতে হবে। তিনি যদি কোন গাছকে সেজদা করার নির্দেশ দিতেন, তবে তাই করতে হত। অতএব কাবা শরীফ পাথরের ঘর হতে পারে, কিন্তু আমরা সে ঘরকে সেজদা করিনি, বরং আল্লাহর হুকুমকে নতশিরে মান্য করছি। তদ্রুপ যারা দাদা পীর কেবলার মতবাদকে মান্য করার স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাদের মরণ পর্যন্ত এর উপর কায়েম থাকতে হবে। তবেই পীর মানা হবে।

তোমরা সাইন বোর্ড দেখে মাতবে না। অনেক সময় দেখবে, হোটেলের সামনে সুন্দর সাইনবোর্ড লটকানো আছে, লেখা আছে, “ইসলামিয়া হোটেল” ।

কত সুন্দর লেবেল, ভিতরে গিয়ে দেখুন যত হারাম খাদ্য প্রস্তুত আছে। তদ্রুপ দাড়ী, টুপি জোব্বা, তসবীহ ইত্যাদি দেখে তার উপর নিজেকে বিলীন করা খুবই মূর্খতার কাজ হবে। কেননা দেখতে হবে তিনি কতটা শরীয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন, দাদা পীর কেবলার নীতির উপর কতটা দৃঢ় আছেন। ইসলামী লেবাস পরে দাজ্জালের চেলা হিসাবে শরীয়তের জড় কাটছেন কিনা তা ভালভাবে দেখে তবে সেদিকে অগ্রসর হতে হবে।

আজকাল অনেক ধাপ্পাবাজ আলেম, পীর, ফকীর, দরবেশ, বেরিয়েছে, যারা চোখ বন্ধ করে বলে থাকে, তোমার বাপের কবরে আজাব হচ্ছে।  আবার কোন ব্যক্তিকে বলে, তোমার ঘরে সাতটি জ্বিন আছে, শীঘ্রই এর ব্যবস্থা কর। এভাবে সাধরণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করে থাকে। যদি এটা সত্যিই হয়, তাহলে সোনা বা পেট্রোলের খনি অনুসন্ধান করার জন্য সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার কোন প্রয়োজন হত না। চক্ষু বন্ধ করে বলে দিতে পারলে সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা তাকে পুরস্কার দিত। এ সহজ সুযোগ ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ধাপ্পা দিয়ে অর্থ উপার্জনের পন্থা অবলম্বন করেছে। এ সব ধোঁকাবাজদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করুন। হোটেল ইত্যাদিতে থাকার যোগ্যতা অর্জন করল, আবার আখেরাতেও জান্নাত রেজিষ্ট্রী রইল, দুনিয়াতে আরাম, আখেরাতেও আরাম। আর গরীব দুঃখীদের টাকা না থাকায় দুনিয়াতেও কষ্ট, আখেরাতেও কষ্ট। এটা কোনদিন হতে পারে?

শুনে রাখো, অর্থের জোরে মানুষ নাজাত পেতে পারে না। নাজাত পেতে গেলে আমল দরকার। তোমাদের জানা আছে নবীর কন্যা ফাতেমার ক্ষেত্রে পরকালে নাজাতের জন্য আমল করার কথা বলা হয়েছিল। নবীর কন্যার ক্ষেত্রে যদি একথা হয়ে থাকে, তাহলে আপনি আমি টাকার জোরে নাজাত পেয়ে যাব তা কোনদিন হয় না। তবে নিজের হালাল অর্থ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে কিছু সওয়াবের অধিকারী হতে পারবে।

তাই বলি, আবেগে পড়ে ধার দেনা করে নিজের সম্পদকে বিলিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনমালিন্য শুরু হয়ে সংসারে অশান্তি দেখা না দেয়। এটা জানা দরকার স্ত্রী হল সংসারের গোড়া, সে যদি বিগড়ে যায়, পীরের পীর গিরি, জর্জের জর্জগিরি, ডাক্তারের ডাক্তারগিরি সবই শেষ হয়ে যাবে। সেজন্য সামর্থ অনুযায়ী প্রত্যেক কাজে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। কথায় বলে, যেমন কম্বল তেমন পা বাড়াও। পীরের দরবারে হাদিয়া নজরানা দিতে গেলেও চিন্তা করে দিতে হবে। যেন দিতে দিতে দেউলিয়া না হয়ে যায়। পরে ছেলেরা বাপকে গালি না দেয়। সুতরাং আলেমদের কথায় না মেতে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী খায়রাত করা দরকার। আমরা মানুষ হিসাবে সকলকে সমান মনে করি, কিন্তু হাকিকতে একে অপরের মধ্যে বহু  পার্থক্য আছে, কোরআন শরীফে  তার প্রমাণ  পাওয়া যায় যে,

একস্থানে আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করলেন, অপর জায়গায় সেই মানুষকেই পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট বললেন, তার দ্বারা প্রমাণ হয়, মানুষ দেখতে এক রকম হলেও কিছু মানুষ এমন আছেন যারা আল্লাহর রাস্তায় অনুশীলন করে নিজ আমলের দ্বারা আল্লার সৃষ্টি জীবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছেন, তারা হলেন আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রিয় বান্দা।

আর কিছু মানুষ আল্লার হুকুমকে অমান্য করে নফসের বশীভূত হয়ে ঈমান আমলের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, লোভ লালসা, হিংসা ফাসাদ ইত্যাদি পার্থিব জীবনের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লার পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজের ইহকাল জীবনের সমাপ্তি ঘটায়, এই সকল মানুষদেরকেই আল্লাহ পাক সম্ভবত পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট বলে বর্ণনা করেছেন।

সমস্ত কাঠ দেখতে এক রকম হলেও চন্দন কাঠের মূল্য অনেক বেশী, তাই মানুষ তার কদর করে থাকে। তদ্রুপ পাথর দেখতে সব সমান হলেও হীরে পাথরের সমতূল্য কোন পাথর হতে পারে না। যে চিনবে সে তার কদর করবে।

ঠিক তেমনই কিছু মানুষ আছেন, যারা দুনিয়ায় বসে আল্লাহ পাকের সমস্ত নেয়ামতকে স্বচক্ষে দর্শন করে থাকেন, আমরাও মানুষ, জ্বিন ও ফেরেশতাদের উপর দর্জা, তা সত্ত্বেও আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না, বরং দুই ফেরেশতা আমাদের স্কন্ধে বসে দিবারাত্র আমাদের আমলগুলী লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। আমরা ঘুনাক্ষরে ও বুঝতে পারি না। অথচ জীবজন্তুরা আল্লাহ পাকের বহু নেয়ামত দেখে থাকে, এমন কি আল্লার গজব দেখে ক্রন্দন করে থাকে।

শিশু বাচ্চাকে দেখবেন, অনেক সময় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসতে থাকে তখন আমরা বলি বাচ্চা ‘খেলা’ করছে। আবার অনেক সময় ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এই হাসা ও কাঁদার মধ্যে কি যে রহস্য আছে তা আমাদের জানা নেই। শুনে রাখো একদল জ্বিন ও ফেরেশতা আছে যারা সর্বদা পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। যখন তারা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে গমন করে, তখন বাচ্চা ছেলেরা দেখে হাসতে থাকে। আবার কিছু দুষ্টু জ্বিন আছে যারা বিকট আকৃতি ধারণ করে গমন করে, তখন ঐ বাচ্চারা ভয়ে চিৎকার করে ক্রন্দন করতে থাকে, তাদের অন্তর স্বচ্ছ থাকায় হৃদয় নামী র‌্যাডার যন্ত্রে সবই ধরা পড়ছে।

তদ্রুপ একদল মানুষ আছেন যারা আল্লাহর রাস্তায় কঠোর পরিশ্রম করে ক্রমাম্বয়ে এমন উচ্চ শিখরে পৌঁছে থাকেন, যা সাধারণ মানুষের অনুভূতি ও জ্ঞানের বাইরে, তারা হলেন আল্লাহর মাহবুব ও আরেফ বিল্লাহগণের পর্যায়ভুক্ত।

কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ আছে, যারা কিছু জানুক বা না জানুক পীর মুরিদ প্রথাটাকে অর্থ উপার্জনের পন্থা হিসাবে মনে করে, বংশ পরস্পরা পীর সেজে মুরিদ করতে থাকে। এটা সম্পূর্ণ নাজায়েজ প্রথা।

কেননা পীরের যে শর্তসমূহ আছে তা যদি পাওয়া না যায় সে পীর হওয়ার যোগ্য নয়। এছাড়া বায়াত হলেই উক্ত পীর সাহেব ও তার বংশধরগণ মনে করেন, যে মুরিদগণ আর অন্য জায়গায় যেতে পারবে না। ক্রয় করা জীব জন্তুর ন্যায় আবদ্ধ হয়ে গেল, এটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়, বরং আধ্যাত্মিকতায় উত্তির্ণ হতে গেলে উপযুক্ত শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে তাসাউফের মাকামগুলি অতিক্রম করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হবে।

মোজাদ্দেদে জামান হযরত দাদা পীর কেবলা (রহঃ) এর স্বাক্ষর সম্মলিত কিছু অসিয়ত যা শরীয়তে ইসলাম পত্রিকায় লিপিবদ্ধ আছে, মাঝে মাঝে তিনি মুরিদদেরকে শুনাতেন, যথা- “পীর মুরিদী পৌরহিত্য প্রথার মত নহে। ইহা সম্পূর্ণ জায়েজ এবং প্রত্যেক প্রকার নাজায়েজ তরিকা হইতে বিমুক্ত। পীরের ছেলে পীর হইবে এরূপ নিয়ম ইসলামে নাই, কিংবা সাধারণ লোকের ছেলে পীর হইতে পারিবে না এরূপ নিয়ম ও ইসলামে নাই। যদি কোন কামেল পীরের ছেলে শরীয়ত অনুসারে উপযুক্ত না হন অর্থাৎ কামেল পীর হইবার যে সমস্ত শর্ত আছে তৎসমুদয়ে শর্তবান না হন, তবে তিনি পীর হইবার যোগ্য নহেন।

যদি কোন সাধারণ লোকের ছেলে উপযুক্ত হন অর্থাৎ শর্তসমূহে সামর্থবান হন তবে নিশ্চয়ই পীর হইতে পারিবেন। ইসলামের নিকট কাবেলিয়াতের (যোগ্যতার) কদর আছে, না-কাবেল কদরের যোগ্য নহে, আজকাল মুসলমানগণ কাবেলিয়াতের দিকে খেয়াল না করিয়া মহা ভুলে পড়িতেছেন, এবং যাকে তাকে পীর বলিয়া গোমরাহ হইতেছেন।

কামেল পীরের জন্য নেক কাজে নসীহত এবং বদ কাজ করিতে নিষেধ করা অবশ্যই প্রয়োজন। যে সমস্ত পীর বদ কাজ করিতে নিষেধ না করেন তাহারা কামেল পীর হইবার যোগ্য নহেন। হক নসীহত করা এবং না-হক কাজ করিতে নিষেধ করে পীরদিগের পক্ষে  একান্ত আবশ্যক। যাহারা ইহা না করেন অর্থাৎ হক কাজে উৎসাহ এবং গোনাহের কাজ করিতে নিষেধ না করেন তাহারা কামেল পীর নহেন। হক কথা বলিবার মত উপযুক্ত সৎ সাহস এবং বাতিলের প্রতিবাদ করিবার মত ক্ষমতা কামেল পীরের থাকা চাই। সমাজের মধ্যে যে কোন প্রকার না হক প্রচলিত হইলে, তাহার তারাদ্দুদ করিয়া হক কাজের প্রচলন করা কামেল পীরের পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। মুসলমানের কোন প্রকার বিপদ আপদের সময়ে তাহার যথাবিহিত প্রতিবিধান করা কামেল পীরের পক্ষে নেহায়েৎ/অত্যান্ত জরুরী। ফেরেববাজ লোকদের সমন্ধে হাদিসে আছে যে, মিথ্যাবাদী ও দাজ্জালগণ আসিয়া নতুন নতুন ফাতওয়া প্রকাশ করিবে। ইহাদের ফেরেব হইতে তোমরা সাবধান থাক এবং সকলকে সাবধান কর যেন তাহারা তোমাদিগকে গোমরাহ করিতে এবং তোমাদের মধ্যে ফেৎনা আনিতে না পারে।

অতএব মুসলমানগণ, খুব হুঁশিয়ারীর সহিত দ্বীন ঈমান বজায় রাখিবেন। যেন কোন মৌলবী, পীর বা নেতা প্রভৃতি নামধারী গোমরাহ লোকের ফেরেবে পড়িয়া এবং তাহাদের প্রচারিত মিথ্যা ফাতওয়া শুনিয়া আখেরাতে জাহান্নাম ও দুনিয়ায় জলাঞ্জলির পথ পরিস্কার করিবেন না। খোদাকে ভয় করুন এবং যাহারা খোদা ভীরু (মোত্তাকী) আলেম পীর নেতা সেই সমস্ত লোকের এত্তেবা করুন। মিথ্যাবাদী, ফেরেববাজ এবং যাহারা মোত্তাকী পরহেজগার নহে, তাহাদের এত্তেবা করিয়া দো-জাহানের ক্ষতি সাধন করিবেন না।

তিনি বলতেন, পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায়, ভবিষ্যতে আমাদের আচরণ এমন হয়ে দাঁড়াবে, মুরিদ মো’তাকেদগণ আমাদের নিকট আসতে ভয় পাবে, তারা কোন প্রকারে মাজার শরীফ জিয়ারত করে প্রস্থান করার চেষ্টা করবে, সুতরাং দেখা যাবে এ স্থান একদিন “জিয়ারত গাহে” পরিণত হয়ে গেছে।

বিভিন্ন নীতির প্রশ্ন তুললে বলতেন, কারো মিষ্টি খেতে ভাল লাগে, আবার কারো তেতো খেতে ভাল লাগে, সবার রুচি সমান নয়। কেউ যদি মোজাদ্দেদে জামানের মতবাদকে না মানে, তার বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা না করে বরং তুমি তোমার নীতিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরার চেষ্টা কর। যার পছন্দ হবে সে গ্রহণ করবে, আর যদি তার সমালোচনা কর, তবে দেখা যাবে সে তার মতের উপর আরো দৃঢ় হবে ও ক্রমান্বয়ে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এতে সিলসিলার লাভ না হয়ে বরং ক্ষতিই হবে।

সুতরাং কারো দোষত্রুটি অনুসন্ধান না করে বরং কোরআন হাদিস মোতাবেক মোজাদ্দেদে জামানের নির্ভেজাল নীতি ও মতবাদকে সামনে রেখে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। তিনি সকলকে একশবার করে “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” পড়তে বলতেন। শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে আল্লাহ্ অথবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর জিকির করতে বলতেন। বর্তমান সময়ে মানুষ কাজ কারবার ব্যবসা বানিজ্য ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকার কারনে অল্প সময়ের মধ্যে যা আমল করা যায় তার চিন্তা করে তিনি সকলকে চিশতীয়া তরিকা মশক করতে নির্দেশ দিতেন।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আরও পড়ুন...

প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
প্রশ্ন: আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না, একথা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষ তার পাপের জন্য দোজখে যাবে কেন? ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ’। এ মারফতি গানটি তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।
প্রশ্ন: বর্তমান বিশ্বে ইসলামের একটা পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখুন না, কত লোক নামাজি হচ্ছে। জুমার নামাজে মসজিদে ঠাঁই হয় না?