মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন। বিয়ে-শাদী, দাফন-কাফন-কুলখানি ইত্যাদিতে মোল্লা মৌলভীদের দাওয়াত করে হাদিয়া দিয়ে থাকেন।
উত্তর: এটা এক ধরনের মোনাফেকি। এ ধরনের ‘মুসলমান’ রাসূলে পাক (সঃ)-এর জমানাতেও ছিল। এদের সম্পর্কে কোরআনের সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি সেই লোকটিকে শ্রদ্ধা করব, যিনি তার বিশ্বাসের আনুগত্য করেন। আল্লাহ-রাসূলে বিশ্বাস না করলে যিনি ধর্ম পরিত্যাগ করেন এবং মোনাফেকি বর্জন করেন। সে অর্থে সে কোন বিধর্মী, যিনি তার নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন, তাকেও আমি শ্রদ্ধা করি।
প্রশ্ন: অশিক্ষিত, অজ্ঞ লোক বিশ্বাস না করলে বুঝতে পারি, কিন্তু শিক্ষিত লোক, যিনি বিদ্যা এবং জ্ঞানের অধিকারী, তিনি কেন আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করবেন না?
উত্তর: জ্ঞানের জগতে, তোমাদের ঐ বিজ্ঞানের জগতেও, খুব বড় বড় সত্যগুলো কিন্তু স্বতঃসিদ্ধ, অ্যাকশিওম্যাটিক। যুক্তি দিয়ে , কিংবা প্রমাণ দিয়ে সিদ্ধ নয় ।আমাদের সমাজের এই বিদ্বান লোক গুলো যখন অংক কষেন কিংবা জ্যামিতির কোনো দুরূহ সমস্যা সমাধান করেন তখন তারা স্বতঃসিদ্ধ কিছু সূত্রকে মেনে নিয়েই কাজ করেন। তোমাদের উচ্চতর গণিতের বেশিরভাগ সূত্রই এখনো স্বতঃসিদ্ধ, আল্লাহর বিশ্বাসও তেমনি একটা সত্য যা স্বতঃসিদ্ধ। যুক্তিতর্ক দিয়ে বেশিদূর এগুলো যায় না। কার্যকারণ সূত্র অনুসরণ করে এক জায়গায় গিয়ে থামতেই হয়। আর তার নামই সিঙ্গুলারিটি বা অনন্যতা। এজন্য কুরআনের শুরুতেই বলা হয়েছে, এই সেই গ্রন্থ যা সন্দেহের উর্ধ্বে এবং এ গ্রন্থ বিশ্বাসীদের জন্য ।তারপর স্বতঃসিদ্ধ সূত্রটি বলা হয়েছে, যা মানলে কোরআন রুপি গোটা অংকটা তুমি কষতে পারবে। না মানলে এ অংক তুমি কষতে করতে পারবে না, এ রহস্যের দোয়ার তোমার সামনে খুলবে না । যেকোনো অংকই তো একটা রহস্য , কোরআনও একটা রহস্য। যাহোক, যে সূত্রটা না জানলে তোমার কোরআনের অংক কষা হবে না তা হচ্ছে, এ গ্রন্থ বিশ্বাসীদের জন্য একটা পথ-নির্দেশ তাদের জন্য যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, সালাত কায়েম করে, আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে নিজের জন্য এবং অপরের জন্য ব্যয় করে, তোমার প্রতি (অর্থাৎ রাসুলে পাক (সঃ)-এর প্রতি) এবং তোমার পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিশ্বাস করে এবং পরকালে বিশ্বাস করে। এই হচ্ছে সেই স্বতঃসিদ্ধ সূত্রটি যা বিনা তর্কে না মানলে কোরআন সম্মত কোন রহস্যেরই সমাধান মিলবে না।
প্রশ্ন: যিনি এ সূত্রটি দিচ্ছেন তিনি নিজেই তো অদৃশ্য। অসুবিধা তো তাকে নিয়েই। বিশ্বাস করলে তিনি আছেন, না করলে নেই
উত্তর: কিন্তু তারও আগে যে প্রশ্ন করা উচিত, তা হলো যার মাধ্যমে এর সূত্র আমরা পাচ্ছি তাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করি কিনা। তিনি মিথ্যাবাদী হলে সমস্ত অংকটার বুনিয়াদি কিন্তু ভেঙে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তার সমাজ তাকে উপাধি দিয়েছিল আল-আমিন বা সত্যবাদী। এ সত্যবাদী যুবকটির মাধ্যমেই সত্য নিজের স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্বকে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই সত্য কেবল তারই জন্য, যে ঐ সত্যবাদী যুবকটিকে বিশ্বাস করেছে এবং তার মাধ্যমে প্রদত্ত এই সত্যসিদ্ধ সূত্রটিকে মেনে নিয়েছে নির্দ্বিধায়, নিঃসন্দেহে। এজন্যই কোরআনে রাসুলে পাক (সঃ) সম্পর্কে বারবার বলা হয়েছে, যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চাও তবে রাসুলের আনুগত্য কর। বেশিরভাগ মুসলমানেরই সুন্নত এবং ফরজ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা আছে। প্রায় সকলেই ফরজকে বড় করে দেখে। কিন্তু এমন কি কেউ আছেন তিনি বলবেন যে, সুন্নত পরিত্যাগ করলে কেবল ফরজ এবাদত আল্লাহ কবুল করবেন? রাসুলে পাক (সঃ)-কে বাদ দিয়ে কোন এবাদত কবুল হবে না। সূরা মায়েদায় (আয়াত ১৫) তার কর্ম এবং স্বরূপ সম্পর্কে তাই বলা হচ্ছে- ‘ইয়া আহলাল কিতাবে ক্বাদ যা-আকুম রাসুলুনা ইউবাইয়েনু লাকুম কাসিরাম মিম্মা কুনতুম তুখফুনা মিনাল কিতাবে ওয়া ইয়া’ফু আন কাসির, ক্বাদ যা-আকুম মিনাল্লাহি নুরুন ওয়া কিতাবুম মুবিন’। ‘হে কিতাবিগন! আমার রাসূল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা কিছু গোপন করতে বা ইচ্ছা করে এড়িয়ে যেতে তিনি তার অনেক কিছু তোমাদের কাছে প্রকাশ করেন। আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি জ্যোতি এবং একটা স্পষ্ট কিতাব। সুতরাং তিনি নিজে হচ্ছেন জ্যোতি, আর জ্যোতিএমন জিনিস যা বিভাজ্য নয়। সত্যের যে জ্যোতি, তিনি তারই অবিভাজ্য অংশ এবং তার মাধ্যমে এসেছে সত্যের বাণী, যাকে বলা হচ্ছে শুদ্ধতম গ্রন্থ, স্পষ্ট কিতাব। আর তিনি আমাদের বিদ্যার্জনকে ফরজ করেছেন। তিনি যখন বিদ্যার জনের জন্য সুদূর চীন পর্যন্ত যেতে বলেন তখন যে বিদ্যার কথা বলা হয় তা হচ্ছে পার্থিব বিদ্যা, জীবনধরনের কলাকৌশল। সেটা হচ্ছে ‘ইলম বিল লিসান’। কিন্তু যে গোপন বিদ্যার কথা সুরা মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তা হচ্ছে গুপ্তবিদ্যা বা ‘ইলম বিল জেনান’। সেটাই ইলমে মারেফত। মনে রেখো, বিদ্যা বা কৌশল শেখার বা শেখানোর জিনিস হতে পারে। কিন্তু ইলমে-মারেফত হচ্ছে জ্ঞান বা উপলব্ধি যার স্থানান্তর সম্ভব হলেও শেখানো সম্ভব নয়। এ মোকামে পৌঁছাবার কলাকৌশল মুর্শিদের কাছ থেকে শেখা যায়, কিন্তু সিদ্ধিটা যার যার অর্জন। যার যার প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: আমাদের এ অর্জন হয় না কেন? আমাদের অনেকেই সাধনা করেন দেখি কিন্তু কিছু লাভ হয় বলে তো মনে হয় না?
আমাদের জীবন জুড়ে রয়েছে একটা বিরাট প্রতারণা। আমরা মুখে বলি রাসূলের আনুগত্য করি কিন্তু কার্যত আমাদের জীবনে আমরা আল্লাহর চেয়ে মানুষকে ভয় করি বেশি। দাড়ি রাখতে গেলে ভাবি লোকে কি বলবে। আমাদের নারীর হেজাবের ব্যাপারটাকে প্রগতি বিরুদ্ধ ভাবি। অফিসের বড়কর্তাকে চাকরির মালিক ভাবি। এসবই শিরক। অথচ আমাদের ধর্ম কর্ম ঠিকই চলছে। মাথায় টুপি আছে। রোজা নামাজ সবই চলছে কিন্তু এদের অবস্থা সেই ছেলেটির মতো, যে তাড়াহুড়া করে অংক কষতে গিয়ে গোড়াতেই ভুল করে ফেলেছে। ফলে তার হিসাব আর মিলছে না। রাসুলে পাক (সঃ)-এর প্রেম ছাড়া কোন অংকই মিলবে না। আর রাসুলে পাক (সঃ)-এর প্রেমে যখন সিক্ত হবে তখন তোমাদের জীবনের স্ববিরোধ গুলো চলে যাবে। মনে রেখো, তোমার রাসুলে পাক (সঃ)-এর হাকিকত সম্পূর্ণ ভিন্ন। হযরত মুসা (আ:) একমাত্র রাসূল যিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। এজন্য তাকে বলা হয় ‘কালিমুল্লাহ’। তিনি আল্লাহকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু তাকে বারণ করা হলো। তিনি শুনলেন না, জেদ করলেন। তখন তাকে তুর পর্বতের দিকে তাকাতে বলা হলো। সূচ্যগ্র পরিমাণ নূর সে পর্বতে প্রচন্ড ঝলকানিতে জ্বলে উঠলো। সমস্ত পর্বত ধ্বংস হয়ে গেল। হযরত মুসা (আ:) অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। আর আল্লাহকে দেখা হলো না। অথচ আমাদের নবীর মেরাজ হল, দিদার হলো আল্লাহর সঙ্গে। মুসা (আ:) এর মত তাকে পাদুকা খুলতে হলো না। দুটি সত্তা একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। সুতরাং আমাদের রাসুলে পাক (সঃ)-এর- মোকাম সম্পর্কেও আমাদের বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। রাসুলে পাক (সঃ) বলেছেন, ‘আমি সজ্ঞানে চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখেছি’। তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি দিনে রাতে বেশিরভাগ সময় আল্লাহর সান্নিধ্যে কাটাই’। সুতরাং এমন যে রাসুলে পাক (সঃ) তার প্রেমই পারে আল্লাহর মারেফত হাসিল করতে। সমস্ত রহস্যের দোয়ার উন্মোচিত করতে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার মারেফত হাসিল করার সৌভাগ্য দান করুন। আমীন।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন