Mobile Menu

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)

শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন

প্রশ্নোত্তর পর্ব

(৪)

আমিত্বের বিড়ম্বনা এবং আধ্যাত্মিক সাধনার শর্তাবলী

প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?

 

উত্তর: আমরা যে নিজেকে চিনি সে একান্তই রক্তমাংসের সত্তা। সে নিজের কামনা-বাসনাকে বোঝে, লোভ-লালসাকে বোঝে, মোহ-মাৎসর্যকে বোঝে। ইন্দ্রিয়সর্বস্ব এ জীবন মানুষের অন্তর্লোকের দুয়ার বন্ধ করে দেয়। কিন্তু যেদিন সে জীবনের হিসাব মিলাতে বসে সেদিন দেখতে পায় হিসাবের পাতা শূন্য। তখনই সে তাঁর নিজের মধ্যে আর একটা সত্তার আহ্বান শুনতে পায় যে তাকে প্রতিনিয়ত নিজের কাছে ডেকেছে অথচ সে ডাক সে শুনতে পায়নি। তখন সে বুঝতে পারে জীবন একটা স্বপ্ন বিশেষ, এক দুয়ার দিয়ে সে স্বপ্নে আমরা প্রবেশ করি, অন্য দুয়ার দিয়ে নিস্ক্রান্ত— হই। যে আমিকে নিয়ে এ স্বপ্নের খেলায় মেতেছিলাম সে পড়ে থাকে এ ধরার ধূলায়, যে আমি আমার মধ্যে চিরন্তন প্রবাহ হয়ে বহমান সে চলে যায় অভিমান ভরে। যে মাটির মানুষ ইন্দ্রিয় সুখে মত্ত হয়ে তাকে চেনার চেষ্টা করলো না সে হতভাগ্য।

 

প্রশ্ন: প্রতিটি মানুষই এক সময় ক্লান্ত হয়ে কি যেন খুঁজে বেড়ায়। তার মধ্যে কে যেন কথা বলে, অথচ সে কথা সে বোঝার চেষ্টা করে না?

 

উত্তর: এটাই অনন্তের তৃষ্ণা। উৎসমূলে ফেরার তাগিদ। প্রত্যেক মানুষই একই উৎস থেকে এসেছে। একই উৎসে তাঁর প্রত্যাবর্তন। মাটির এ দেহটির মধ্যে আল্লাহ নিজের রুহটিকে ফুঁকে দিয়েছেন। এই রুহই হচ্ছে তাঁর আদেশ অর্থাৎ একটা শক্তি যা মাটির দেহকে সচল রাখে। এটাই তাঁর আত্মা, তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি। অন্যদিকে মাটির দেহের কতগুলো স্বাভাবিক প্রবণতা আছে যা তাকে সহজে আকৃষ্ট করে। অনেকটা চুম্বকের মতো। মানুষ এই চৌম্বকত্বকে অস্বীকার করে যখন আত্মার দিকে ধাবিত হয় তখনই প্রকৃতপক্ষে সে তার মধ্যে সেই চিরন্তন আমিকে চেনার চেষ্টা করে। আর চিনতে যখন পারে তখন এই মাটির আমিটা নিঃশেষে সেই চিরন্তন আমির মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এটাই মানুষের সাধনা আর এখানেই যত বিপদ।

 

প্রশ্ন: বিপদ বলছেন কেন?

 

উত্তর: মানুষের এই ‘আমি’ টাকে নিয়েই যত বিপদ। সে কিছুতেই নিজের পার্থিব অহমিকাকে ভুলতে পারে না। আমরা যে যেখানে আছি, সেটাই আমাদের চারপাশে একটা অহমবোধের সৃষ্টি করে। সে অহমিকা আমাদের তাড়িত করে। সেজন্যই আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের মুহূর্তেই এই আমিত্বকে বিসর্জন দিবার

 

তালিম দেওয়া হয়। আমার নানাজান শাহ কারামত আলী জৌনপুরি (রহঃ) একবার তাঁর এক বিশিষ্ট অনুরাগীকে পরীক্ষা করেছিলেন এক অভাবনীয় উপায়ে। ভদ্রলোক ছিলেন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি। তিনি তাঁর মুরিদ হতে চাইলেন। নানাজান চাইলেন তাকে নানাভাবে নিবৃত্ত করতে। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। অবশেষে নানাজান জানতে চাইলেন তিনি তাঁর সব হুকুম বিনাবাক্য ব্যয়ে মানবেন কিনা। বিচারপতি নত মস্তকে সে শর্ত মেনে নিলেন। অতএব তিনি নানাজানের মুরিদ হলেন। কিন্তু মুরীদ হবার পর নানাজান তাকে হুকুম করলেন রেলষ্টেশনে মানুষের মোট বইবার জন্য এবং তাদের জুতা পরিষ্কার করার জন্য। এই মুরিদ অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ পরীক্ষাটা আসলে সেই আমিত্বের পরীক্ষা, অর্থাৎ মিথ্যা আমিত্বকে বিসর্জন দিতে পারলো কিনা সে পরীক্ষা। আমাদের ছোটবড় প্রত্যেকেরই এই আমিত্ব রয়েছে, এ থেকে নিজেকে সর্বতোভাবে মুক্ত করা খুবই কঠিন।

 

প্রশ্ন: আধ্যাত্মিক সাধনার পথে আর কোন বিষয় প্রাথমিক শর্ত হিসেবে গণ্য হবে?

 

উত্তর: আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশের আটটি পূর্বশর্ত আছে। এগুলো হচ্ছে ১. কাসবে হালাল; ২. সিদকে মিকাল; ৩. এরাদায়ে মুসতাহাকাম; ৪. নজর বরকদম; ৫. হোশ দরদম; ৬. নেগাহ দাশত; ৭. বাজগাশ্ত; ও ৮. কুফে জমানি।

 

প্রশ্ন: এগুলো ফার্সি শব্দ, একটু বাংলায় ব্যাখ্যা করলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হতো।

 

উত্তর: কাসবে হালাল হচ্ছে হালাল রুজি বা বৈধ উপার্জন। একটা কথা সকল ধর্মপ্রাণ মানুষকেই মনে রাখতে হবে, নামাজ বলো, রোজা বলো, হজ্ব বলো, এ সবই অর্থহীন যদি রুজি হালাল না হয়। উপার্জন করে মানুষ নিজে খায় এবং স্ত্রী-পুত্রকে খাওয়ায়, সুতরাং এই উপার্জন অবৈধ পথে হলে, হারাম হলে, মানুষের দেহটার মধ্যে হারাম প্রবিষ্ট হয়। সে দেহ যতই সাধনা করুক তাতে সিদ্ধিলাভ হবে না। এর সঙ্গে দ্বিতীয় যে শর্তটি তাকে অবশ্যই পালন করতে হবে তা হচ্ছে সত্যকথন। যে মানুষ মিথ্যা কথা বলে তার সাধনারও কোন অর্থ হয় না। এ দুটো শর্ত থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের জীবন যদি সততার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে সাধনায় সফলকাম হওয়া যাবে না। মানুষের কথায় এবং তার জীবনচর্চায় গড়মিল থাকলে চলবে না। তৃতীয় শর্তটি হচ্ছে এরাদায়ে মুসতাহাকাম বা সংকল্পের দৃঢ়তা। সাধকের মন যদি নমনীয় হয় সামান্য কষ্টেই সে যদি অধীর হয় তাহলে সাধনা সম্ভব নয়। চতুর্থ শর্ত হচ্ছে, নজর রাখা। মানুষ প্রতিদিনের জীবনে যে কাজ করে সেগুলোই তার আমল, সেগুলো মিলিয়ে তার চরিত্র। সুতরাং তাকে অবশ্যই নিজের আমলের দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে তার ভুল না হয়, কিংবা সীমা লংঘন না করে।

 

পঞ্চম শর্তটি হচ্ছে, হোশ দরদম বা প্রতি পলকে আল্লাহকে স্মরণ করা। সাধকের জন্য কেবল ফরজ এবাদত প্রেমের দুয়ার উন্মুক্ত করে না। প্রেমের জন্য চাই নফল এবাদত যা সাধক এবং তার প্রেমাস্পদের মধ্যে সেতুবন্ধন। সেটাই ফরজে দায়েমি, আল্লাহর জিক্র বা স্মরণ। প্রতি পলকে, প্রতি নিঃশ্বাসে তাঁকে স্মরণ করা। ষষ্ঠ শর্তটি হচ্ছে নেগাহ্ দাশ্ত বা দৃষ্টিকে সংযত করা। যার দৃষ্টি তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই তার পক্ষে সাধক হওয়া সম্ভব নয়। আর এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। পৃথিবীর যত রূপ-রস সবই চোখের মাধ্যমে আমাদের চেতনার সঞ্চারিত হয়। চোখ যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে অমঙ্গল সে চোখের ভেতরে প্রবেশ করবেই। আর সেটাই হবে সাধনার ইতি। সপ্তম শর্তটি হচ্ছে বাজগাশ্ত বা নির্জনে নিজেকে যাচাই করা। অন্ধকারে বসে একান্ত নিরিবিলিতে নিজের আয়নাতে নিজেকে দেখা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। সে মানুষই সাধক হতে পারে যে নিজের বিচার নিজে করার ক্ষমতা রাখে। সর্বশেষ শর্তটি হচ্ছে ওকুফে জমানি বা সবকিছু উপেক্ষা করে সংকল্পে অটল থাকা। পৃথিবীতে মানুষের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে অন্যে তাকে কী বলবে। সমাজের এ চোখকে মানুষ সমীহ করে, ভয় পায়। সমাজ ঠিক রাখতে গিয়ে সে অনেক ক্ষেত্রে ধর্মকে অবহেলা করে। কিন্তু প্রকৃত সাধক এ সব কিছুই বিবেচনায় না এনে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নিজ লক্ষ্য অর্জনে অটল থাকে। 

 

প্রশ্ন: এ আটটি শর্ত মানলে মানুষ জীবনে অন্য কি পাবে জানি না, কিন্তু সে যে ভাল মানুষ হবে এতে কোন সন্দেহ নেই?


উত্তর: ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করার নামই তো সাধনা। ভাল মানুষ না হয়ে কেউ সাধক হতে পারে না। ভাল মানুষ যিনি তিনি সর্বক্ষেত্রেই নিজেকে অন্যের চেয়ে ছোট মনে করেন। অন্য সবাই তার চেয়ে বেশি জ্ঞানী, বেশি ধার্মিক এমন ভেবে অন্যকে সম্মান করেন। আমিত্ব যার মধ্যে প্রবল তাঁর পক্ষে অন্যকে সম্মান করা সম্ভব নয়। ভুলে যেও না আল্লাহর কোন নাম নেই। আল্লাহ শব্দের কোন অর্থ নেই। বিধাতা নিজে নামহীন হয়ে সর্বনাম হয়ে গেছেন, সেজন্যই ‘হু’ বা ‘তিনি’ই তার একমাত্র পরিচয়। আর সকল সাধনার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁর মধ্যে নিঃশেষে বিলীন হওয়া।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আরও পড়ুন...

মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
প্রশ্ন: আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না, একথা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষ তার পাপের জন্য দোজখে যাবে কেন? ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ’। এ মারফতি গানটি তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।

সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব 

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন