মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: বর্তমান বিশ্বে ইসলামের একটা পুনর্জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশেও দেখুন না, কত লোক নামাজি হচ্ছে। জুমার নামাজে মসজিদে ঠাঁই হয় না?
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ! কমিউনিজমের পতনের পর সারা বিশ্বে চিন্তার জগতে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাঁচার জন্য প্রত্যেক মানুষেরই একটা বিশ্বাস চাই। যে নাস্তিক তারও কিন্তু একটি বিশ্বাস আছে। তার বিশ্বাস নেতিতে নেতি নিয়েই সে বেঁচে থাকে। বর্তমান বিশ্বে চিন্তার যে শূন্যতা তারই ফলে মানুষ নতুন করে ইসলামের দিকে তাকাচ্ছে। ইসলামের মধ্যে মানুষ খুঁজে পাচ্ছে তার আত্মার নোঙর। পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের আবেদন তাই এত ব্যাপক। কিন্তু নামাজির সংখ্যা বাড়লেই ইসলামের পুনর্জাগরণ হলো এমন কথা ভাবা ঠিক হবে না।
প্রশ্ন: কেন?
উত্তর: বেশীরভাগ মানুষই কিন্তু গড্ডালিকা প্রবাহে চলে। আত্ম-সমালোচনা করার ক্ষমতা তাদের নেই। নিজের আত্মার ভার এক জায়গায় গছাতে পারলেই নিশ্চিন্ত হয়। এ জন্য এ দেশে পীরি মুরিদীর এত ব্যাপক প্রসার হয়েছে। এও কিন্তু এক ধরনের আত্ম-প্রবঞ্চনা।
প্রশ্ন: আত্মা-প্রবঞ্চনা!
উত্তর: হ্যাঁ, আত্ম-প্রবঞ্চনা। নিজের সঙ্গে নিজের প্রতারণা। কারণ কোরআনে একজন ওয়াসিলা খুঁজে নেবার কথা বলা হয়েছে। ওয়াসিলা কিসের জন্য? পথ চলার জন্যে। যিনি ওয়াসিলা তার দায়িত্ব হচ্ছে পথের সন্ধান দেওয়া। আর মুরিদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হওয়া। কিন্তু কিছু লোক আছে তাদের পথ চলার সময় নেই। তাদের পথই ভিন্ন। অথচ বিবেক খোঁচা দেয়। অশান্ত বিবেককে শান্ত রাখার জন্য এরা পীরের কাছে যায়। গাড়ি হাঁকিয়ে পীরের বাড়ী যায়। পীরকে দামী নজরানা দেয়। অবৈধ ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধির জন্য পীরের কাছে তদবির করে মসজিদে চাঁদা দেয়। মাদ্রাসায় অর্থ সাহায্য করে। সকাল বেলা তসবিহ দোলাতে দোলাতে রাস্তায় মর্নিং ওয়াক করে।
প্রশ্ন: এগুলো কি খারাপ কাজ?
উত্তর: কাজগুলো খারাপ সে কথা বলছি না। সব কাজেরই ভালো মন্দ নির্ভর করে তার উদ্দেশ্যের সততার উপর। ইন্নামাল আ’মালু বিন নিয়্যাত। প্রথম কথা হচ্ছে কি উদ্দেশ্যে তুমি এ কাজগুলো করছো। এতে আত্মশুদ্ধির পথে যাচ্ছো, নাকি বিবেকের সেলামি দিচ্ছ। বেশীরভাগ লোকই হারাম রুজির অংশ দান করে বিবেকের সেলামি দিয়ে থাকে। আত্মশুদ্ধি অন্য জিনিস। আর তসবিহ হাতে মর্নিং
ওয়াক যারা করেন তারা একটি কথা ভুলে যান যে, যে কোন নফল এবাদতই হচ্ছে গোপন জিনিস। ফরজ এবাদত প্রকাশ্যে করতে হয়। কিন্তু সব নফল এবাদত মানেই আল্লাহর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক। সেটা সর্বক্ষেত্রেই লোকচক্ষুর অন্তরালে করতে হবে। এসব কথা অবশ্য তোমাদের পীর সাহেবদেরই বলে দেবার কথা ছিল। তোমাদের পীর সাহেবদের বসার দরবার শুনেছি খুব জাঁকজমকপূর্ণ হয়?
প্রশ্ন: জ্বী বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পীর সাহেবদের দরবার বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। কোন কোন ক্ষেত্রে দর্শনার্থী ও মুরিদদের সংবর্ধনাও শ্রেণীমত হয়ে থাকে। গাড়ির মালিকদের এক ধরণের সংবর্ধনা, ভিআইপিদের এক রকম এবং অন্যদের জন্য আম বন্দোবস্ত থাকে। পীর সাহেব মাঝখানে গদীতে বসেন শাহী কায়দায়।
উত্তর: একটা আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো! হুজুর পাক (সাঃ) যখন সাহাবীদের মাঝে বসতেন তখন কিন্তু চট করে তাকে সনাক্ত করা যেতো না। তাঁর নিজের পোশাকও ছিল অতি সাধারণ এবং তিনি সকলের মাঝে বসতেন এমনভাবে যে, তাতে তিনি যে তাঁদের চাইতে পৃথক তা স্পষ্ট বোঝা যেত না।
প্রশ্ন: নবী করিম (সাঃ) কি নজরানা নিতেন?
উত্তর: এই প্রশ্নের উত্তরে সরাসরি হ্যাঁ বা না বলতে পারছি না। তিনি নজরানা নিতেন, যেমন নিয়েছিলেন মদিনা শরীফে গিয়ে হযরত আবু আইউব আনসারীর (রাঃ) বাড়ীতে আতিথ্য গ্রহণের সময়। আবু আইউব আনসারী এতই দরিদ্র ছিলেন যে, রাসূলে পাক (সঃ) তাঁর বাড়ীতে গেলে তিনি বিনীতভাবে বললেন, ‘হুজুর আপনার এসতেকবাল করার জন্য আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না। কারণ আমার পরনের সামান্য কাপড় উঠে দাঁড়াবার জন্য পর্যাপ্ত নয়’। হুজুর পাক (সাঃ) তাঁর কথা শুনে মাটিতে বসে পড়লেন। সঙ্গে বসলেন মদিনার ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা তাকে নজরানা দিলেন। হুজুর পাক ১১৭টি উট পেয়েছিলেন। এর সবই তিনি হযরত আইউব আনসারীকে দান করলেন। নিঃস্ব আবু আইউব আনসারী প্রভূত ধনসম্পদের মালিক হলেন। হুজুর পাক (সাঃ) দু’জনের নজরানা গ্রহণ করেননি। দু’জনেই মোনাফেক ছিল, একজন আবদুল্লাহ বিন ওবাই এবং অপরজন হচ্ছে আস বিন মুগিরা। নজরানা হালাল রুজির না হলে রাসূলে পাক (সঃ) গ্রহণ করতেন না। তাছাড়া নজরানার রীতিকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত আয়ের উৎস হিসেবে কখনোই গণ্য করেননি। যা পেতেন সবই পরার্থে দান করতেন। নিজের আয়ের জন্য নিজে পরিশ্রম করতেন ব্যবসা করতেন।
প্রশ্ন: পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মযাজকদের বেশীরভাগই উচ্চ শিক্ষিত। আমাদের আলেমগণ বেশীর ভাগই স্বল্প শিক্ষিত। এর ফলে আমাদের কি ক্ষতি হয়েছে?
উত্তর: এর ফলে দেশের শিক্ষিত তরুণদের কাছে ধর্মের কোন আবেদন নেই। গোড়া থেকেই ধর্ম সম্পর্কে তাদের কোন আগ্রহ থাকে না। ধর্ম হয় তাদের কাছে গেলাফে আবদ্ধ কোরআন শরীফ তাঁকে মাঝে মাঝে চুমু খাওয়া যায়, কিন্তু পড়া হয় না, জানা হয় না। এ তরুণ ধর্মকে বিজ্ঞানের পাশে কুসংস্কার মনে করে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। অথচ ধর্মই যে দর্শন এবং বিজ্ঞানের ভিত্তি কথা বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা স্বল্পশিক্ষিত আলেমের নেই। ফলে এ তরুণ কার্ল মার্কস সম্পর্কে যতটা আগ্রহী হয় কোরআন সম্পর্কে ততটা নয়।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ে আমাদের ধর্মের সীমাবদ্ধতা কি?
উত্তর: সীমাবদ্ধতা অনেক, সীমাবদ্ধতাগুলো সৃষ্টি করেছি আমরা নিজেরা। আমরা কতগুলো মানসিক বৃত্ত রচনা করেছি। আমরা অনেকেই মনে করি আল্লাহ্ কেবল মুসলমানের জন্য। রাসূল (সাঃ)-ও কেবল মুসলমানের জন্য। এছাড়া আমাদের কোন ধর্মালোচনা শোনার সুযোগ আমরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য রাখিনি। এই তো গেল এক ধরনের কূপমন্ডুকতা। অন্যদিকে, ধর্মকে সযত্নে রেখেছি মসজিদের অভ্যন্তরে। তাকে প্রাত্যহিক জীবনে আনছি না। আনতে ভয় পাই। কারণ তাতে আমাদের জীবন বিপর্যস্ত হবে। ফলে আমাদের বাইরের পোশাক-পরিচ্ছদ, দাড়ি, টুপি সবই ঠিক আছে। কিন্তু আবার হারাম রুজিও ঠিক আছে। মসজিদের জায়গায় মসজিদ আছে জীবনের জায়গায় জীবন। দুয়ের মাঝখানে এক বিরাট দেয়াল। এ পরিস্থিতিতে নামাজীর সংখ্যা যতই বাড়ুক, তাতে ইসলামের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে এ কথা বলা যাবে না। এর প্রতিকারের জন্য তরুণকেই এগিয়ে আসতে হবে। একদিন হুজুর পাক (সাঃ)-এর পাশে যেমন দাঁড়িয়েছিলেন হযরত আলী (রাঃ)-এর মত তরুণ। বিদ্যায় বুদ্ধিতে তারুণ্যে এরাই শিশু ইসলামকে লালন করেছিলেন। ধর্ম এবং জীবনের মাঝে আজকে যে দুর্ভেদ্য দেয়াল উঠেছে একেও ভাঙতে হবে আজকের তরুণ সমাজকেই।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন