মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: গত জুমআর তাকরিরে আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির উপর মন্তব্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আপনি উদ্ধৃত করেছেন। এ সম্পর্কে একটু বললে পাঠক উপকৃত হবেন?
উত্তর: রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন শেষ যমানায় এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ মানুষের অত্যাচারে জর্জরিত হবে, মানুষ মানুষের ভয়ে অস্থির হবে। তখন বুঝতে হবে যে কিয়ামত নিকটবর্তী।
প্রশ্ন: আমরা কি সে ভয়াল সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি?
উত্তর: হাদিসে কিয়ামতের যেসব লক্ষণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো কি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছ না? এ লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখলেই তো পার। প্রথমত, সমাজের মুসলিম নারী তার স্বামী কিংবা পিতামাতার আদেশ অমান্য করে নিজের খেয়াল-খুশিতে চলবে। অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে, পিতারা তাদের কন্যাদের দিয়ে ব্যবসা করাবে। স্বামীরা সতীসাধ্বী স্ত্রীদের দ্বারা অবৈধ ব্যবসা করাবে। আর স্বামীরা স্ত্রীদের উপর্জনের উপর বসে বসে খাবে, ইত্যাকার লক্ষণগুলো যখন দেখবে তখন বুঝবে কিয়ামত নিকটবর্তী। দ্বিতীয়ত, আলেমদের কাছ থেকে তাদের বিদ্যা কেড়ে নেয়া হবে। তৃতীয়ত, আলেমদের মধ্যে ধর্মগত মতানৈক্য চরম আকার ধারণ করবে। চতুর্থত, ধর্মবোধ নেই, মানবতা নেই, এ ধরনের মুসলমান নামধারী লোক তোমাদের শাসনকর্তা হয়ে বসবে। পঞ্চমত, আত্মকলহে লিপ্ত মুসলমান একে অপরকে নির্দ্ধিধায় হত্যা করবে।
প্রশ্ন: লক্ষণতো সবগুলোই মিলে যাচ্ছে?
উত্তর: অথচ তোমাদের মর্তবা কি ছিল। ইসলাম এসেছে পৃথিবীতে মুর্দাকে জিন্দা করার জন্যে, জীবিতকে মুর্দা করার জন্যে নয়। সূরা ফাতিরের ১০ নং আয়াত কিংবা সূরা ইব্রাহিমের ২৪ নং আয়াতে দেখ কলেমা তাইয়্যেবার স্থান কোথায়। এই কলেমা তাইয়্যেবার মন্ত্রে যাঁরা দীক্ষিত তাঁদের স্থান তো হবে আকাশের উচ্চতায়। মুসলমানের মান-ইজ্জত তো ধূলিতে লুটাবার নয়। তোমাদের সমাজে আজ নারীর সম্ভ্রম নেই, পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, এক ভাই অন্য ভাইকে হত্যা করছে, মানুষ আজ মানুষের অত্যাচারে জর্জরিত অথচ বিচার নেই কোথাও, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ব্যক্তিগত ঈর্ষা, দ্বেষ, জেদাজেদিকে, স্বার্থান্ধ ক্ষমতার লিপ্সাকে আজ তোমরা রাজনীতি বলছো। একদিকে অবরোধ অসহযোগ দিয়ে তোমরা সমস্ত দেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশাকে ডেকে এনেছো। অন্যদিকে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্যে ভোটের নামে একটা প্রহসনকে হালাল করার চেষ্টা করছো। সমস্ত দেশ আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকে একটা তৃতীয় শক্তি ওৎ পেতে আছে তোমাদের এই অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে আবার তোমাদের কাঁধে গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে দেবার জন্যে। ইতিহাসের কোন পর্যায়েই তোমরা স্বাধীন ছিলে না। আল্লাহর অশেষ নেয়ামতে তোমরা ১৯৭১ সালে গোলামির জিঞ্জির কেটে স্বাধীন হয়েছো। এই অমূল্য নেয়ামতকে আজ তোমরা হেলায় হারাতে বসেছো। তোমরা যদি এভাবে চলো তাহালে তোমাদের এ স্বাধীনতা তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে। অথচ তোমরা জান না তোমাদের এ সোনার দেশের মাটির নিচে কি অন্তহীন সম্পদ রয়েছে। এ দেশের মাটির নিচে তেলের খনি আছে, এত বিপুল পরিমাণে আছে যে একদিন সারা পৃথিবীকে তোমাদের দুয়ারে আসতে হবে জ্বালানির জন্যে। তোমাদের দেশে বিপুল খনিজ সম্পদ রয়েছে, এমনকি হীরার খনিও রয়েছে। তোমরা যে সম্পদ নিয়ে কুকুরের মত কামড়াকামড়ি করছো সেই ঐশ্বর্যের তুলনায় এ তো কিছুই নয়। আমি নেতাদের চিনি। চিনি বলেই তাদের বলছি বিরোধের এ পথে মঙ্গল নেই। সবচেয়ে বড় কথা নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্যে দেশকে ধ্বংস করার কোন অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা একে অপরের গলা কাটতে উদ্যত হয়েছো। অথচ কুরআন পাকে বলা হয়েছে- ‘ওয়া তাসিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াউ ওয়ালা তাফাররাকু’ (সুরা ইমরান/১০৩)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত হাতে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। এখানে রজ্জু মানে কলেমা তাইয়্যেবা, যাঁরা এই মন্ত্রে দীক্ষিত তাঁদের একে অপরকে শক্ত হাতে ধরে থাকতে বলা হচ্ছে। অথচ বিভেদের হিংসায় উন্মত্ত যারা তারা মুসলমান বলে দাবি করে। নেতারা যদি সবাই মুসলমান হবেন তবে কুরআনের এই আদেশ তারা অমান্য করছেন কেন? আমি জানতে চাই তাদের কাছে। কেন তারা এ হিংসায় মত্ত? তোমাদের দেখেশুনে সেই পাগলের কথা মনে পড়ে। এক পাগলাগারদে একদিন এক পাগল পাগলাগারদের অধ্যক্ষের চেয়ারে বসে পড়লো। এর মধ্যে আরো কয়েকজন পাগল এসে হাজির হলো। অধ্যক্ষ সাহেবও আসলেন। প্রথম পাগলটি বললো, জানেন ভাইসব এই যে লোকটি (অধ্যক্ষ সাহেব) এই লোকটি পাগল, ও আমার চেয়ার দখল করে নিতে চায়। এর মধ্যে আরেক পাগল প্রথম পাগলকে চেয়ার থেকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে বললো, ভাইসব আসলে এই লোকটাই (প্রথম পাগল) পাগল। আর এই যে চেয়ার দেখছেন, এ চেয়ার আমারই প্রাপ্য। তোমাদের দেশের রাজনীতি আজ এই পাগলামির নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেয়ার একটা, আর ঐ চেয়ারে সব পাগলই এসে বসতে চায়। দেশবাসী সকলেই আজ একথা জেনে রাখুক মানুষের প্রথম ভালোবাসা হচ্ছে মানুষের প্রতি। এরপর হচ্ছে ধর্মের প্রতি ভালোবাসা। যারা মানুষকে ভালোবাসতে জানে না তাদের কোন ধর্ম নেই। তারা অন্ধ। এখনো সময় আছে বিরোধ সহিংসতা পরিহার করে মানুষের মর্যাদায় সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসো। তা না হলে ধ্বংস অনিবার্য। সে ধ্বংসের আগুনে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।