Mobile Menu

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)

শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন

প্রশ্নোত্তর পর্ব

(১১)

ক্রোধের আগুন এবং ওজুর পানি

প্রশ্ন: দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ জিনিস কি?

 

উত্তর: খুব কঠিন প্রশ্ন। এমন কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো এমন বিদ্যা আমার কোথায়? তার চেয়ে বরং একটা গল্প শোনাই শোন। একবার বাদশাহ আলমগীর, বাদশাহ আলমগীর কে জান তো! মুগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবই বাদশাহ আলমগীর। ফতোয়ায়ে আলমগীরির নাম নিশ্চয়ই শুনেছো। ওটা তাঁরই সময় বুজুর্গানে দ্বীনের সহায়তায় রচিত। যা হোক, বাদশাহ আলমগীর একদিন তাঁর বাবুর্চিকে ডেকে বললেন, দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম জিনিস যা তাই রান্না করে নিয়ে এসো। ‘জো হুকুম জাহাপনা’ বলে বাবুর্চি চলে গেলো। সে দিন খাওয়ার সময় বাদশাহ জানতে চাইলেন সবচেয়ে উত্তম জিনিস রান্না হয়েছে কিনা? বাবুর্চি জানালো, হয়েছে। বাদশাহ জানতে চাইলেন, জিনিসটি কি? বাবুর্চি বললো, জিনিসটি খাসীর জবান অর্থাৎ খাসীর জিহ্বা। বাদশাহ তৃপ্তিভরে আহার করলেন। কিছুদিন পর বাদশাহ আবার বাবুর্চিকে ডাকলেন। বললেন, দুনিয়াতে সবচেয়ে খারাপ জিনিস যা তাই রান্না করে নিয়ে এসো। বাবুর্চি চলে গেলো। সেদিন খাওয়ার সময় বাদশাহ জানতে চাইলেন, কি রান্না হয়েছে। বাবুর্চি বললো, জাঁহাপনা খাসীর জবান। বাদশাহ অবাক হয়ে বললেন, সবচেয়ে ভালো জিনিস খেতে চাইলাম সেদিনও খাওয়ালে খাসীর জবান। আর আজ সবচেয়ে খারাপ জিনিস খেতে চাইলাম আজও রান্না করলে খাসীর জবান, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বাবুর্চি বললো, আলমপনা, পৃথিবীতে জবান অর্থাৎ জিহবার চেয়ে ভালো জিনিস যেমন কিছু হয় না, তেমনি জবানের চেয়ে খারাপ জিনিসও কিছু হয় না। বাদশাহ বাবুর্চির বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরস্কৃত করলেন।

 

 প্রশ্ন: আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি। আচ্ছা হুজুর, এই যে এতো মানুষ আপনার কাছে হেদায়েত লাভের জন্যে আসে, আপনি যদি ওদের একটি মাত্র বাক্যে নসিহত করতেন, তাহলে ওদের কি বলতেন?

 

উত্তর: কোরআন বলছে হেদায়েত করার মালিক আল্লাহ স্বয়ং। সুতরাং হেদায়েত করার অধিকার কোন মানুষের নেই, মানুষের সেই শক্তিও নেই। সুতরাং এখানেও আমি  নিজের কথা বলতে চাই না। এসো, আর একটা গল্প শোনাই। একবার হুজুরে পাক (সাঃ)-এর কাছে একটি লোক এসে বললো, হুজুর, আপনি আমাকে নসিহত করুন। এর অর্থ তো নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। অর্থাৎ লোকটি বলতে চাইলো, আমাকে এমন নসিহত করুন, যেন আমি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। হুজুর পাক (সাঃ) বললেন, (বোখারী শরিফের হাদিস) তুমি কখনো রাগ করো না। লোকটি ভাবলো, এ আবার কি নসিহত। সে ভাবলো, হুজুর পাক (সাঃ)

 

বোধহয় ভালো করে শুনতে পাননি। তাই সে আবার বললো, হুজুর, আমাকে নসিহত করুন। হুজুর পাক (সাঃ) আবার বললেন, তুমি রাগ করো না। অধৈর্য হয়ে লোকটি তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্ন করলো। হুজুর পাক (সাঃ) পরম প্রশান্তি নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, তুমি রাগ করো না। অর্থাৎ হুজুর পাক (সাঃ) এ কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন যে, যারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রয়াসী তাদের জন্যে রাগ হচ্ছে একটা হারাম অনুভূতি। যারা নিজের রাগ খেয়ে ফেলে অর্থাৎ ক্রোধ সংবরণ করতে পারে, আল্লাহ তাদের সমস্ত ত্রুটি মাফ করে দেন এবং তাদের আপন সান্নিধ্যে টেনে নেন। মনে রেখো, রাগ মানুষের সমস্ত এবাদত বরবাদ করে দেয়। হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আল্লাহর কাছে কোন্ বান্দা সবচেয়ে প্রিয়? আল্লাহ বলেছিলেন, সেই বান্দা যে সবচেয়ে বেশি মাফ করতে পারে। মানুষ এই যে বীরত্ব নিয়ে অহংকার করে বীরত্বের চিহ্ন কি?

 

প্রশ্ন: যুদ্ধে কৌশল এবং শক্তি দুই-ই যে ব্যবহার করতে পারে, তাকেই তো আমরা বীর বলি। সেটাই তো বীরত্বের চিহ্ন।

 

উত্তর: না হে, প্রকৃত বীর হচ্ছে সে যে রাগের বশবর্তী হয়ে রাগের ক্রীতদাসে পরিণত হয় না। ক্রোধ যে সংবরণ করতে পারে, সেই হচ্ছে প্রকৃত বীর এবং সেটাই বাহাদুরি। হযরত আলী (রাঃ)-এর সেই গল্পটির কথা মনে করে দেখ। খন্দকের যুদ্ধে বিশালদেহী এক যোদ্ধা তাকে দ্বৈরথে আহ্বান করলো। হযরত আলী (রাঃ) তাকে ধরাশায়ী করে বুকে চেপে তলোয়ার চালাতে উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় লোকটি হযরত আলীর মুখে থু থু দিলো। হযরত আলী (রাঃ) সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরণ করে তাকে ছেড়ে দিলেন। লোকটি অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইল। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, আমি এতোক্ষণ যুদ্ধ করেছি আল্লাহর জন্যে। কিন্তু যে মুহুর্তে তুমি আমার মুখে থু থু দিলে সে মুহুর্তে আমার প্রচন্ড রাগ হলো। তখন যদি আমি তোমাকে হত্যা করি তাহলে সেটা হবে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। কিন্তু আমি তো যুদ্ধ করছি আল্লাহর জন্যে নিজের জন্যে নয়। আল্লাহকে প্রতি ক্ষণে স্মরণ রাখলেই রাগ হবে না। রাগ হয় তখনই, যখন তুমি তাকে বিস্মৃত হও। একবার পরীক্ষা করে দেখো। রাগ হবার পরের মুহুর্তে একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে, রাগের মুহুর্তে তুমি আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিলে। হুজুর পাক (সাঃ) অবশ্য দু’একটি কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। রাগ তো একটা শত্রু – শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে কৌশল চাই। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই রাগ হচ্ছে শয়তানের শক্তিগুলোর অন্যতম। শয়তান আগুনের তৈরী আর আগুন পানিতে নিভে যায়। অতএব তোমাদের যখন রাগ হয়, তখন পানি দিয়ে ওজু করে নাও। রাগ হলে ঠান্ডা পানিতে ওজু করে নিও। তাহলে দেখবে রাগ কমে গেছে।

 

 

প্রশ্ন: আর কোন কৌশলের কথা কি হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন?

 

উত্তর: হ্যাঁ বলেছেন। এটা হযরত আবুজর গিফারি (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস। হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, দাঁড়ান অবস্থায় যদি তোমাদের রাগ হয়, তাহলে বসে যাও। আর তাতেও যদি রাগ প্রশমিত না হয়, তাহলে মাটিতে শুয়ে যাও। এ কৌশলটি ব্যবহার করে দেখো, দেখবে রাগ আর নাই। ভুলে যেও না, রাগ হচ্ছে এক ধরনের আগুন, শয়তানও আগুনের তৈরি। রাগের দাস যে হয়ে যায়, সে তো শয়তানের দাস হয়ে যায়। কিন্তু আবার এ কথাও সত্যি, যে মানুষের রাগ নেই সে মু’মিন হতে পারে না।

 

প্রশ্ন: সে কেমন?

 

উত্তর: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবমাননায় যে রাগ করে না—যার রাগ হয় না– সে মু’মিন হবে কেমন করে? কারণ আল্লাহর জন্যে ভয় এবং আল্লাহর জন্যে রাগ হচ্ছে এবাদত। সে রাগ আবার হালাল রাগ। সুতরাং রাগ হচ্ছে একটা শক্তি, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি তুমি যখন অর্জন করবে, তখনই তুমি হবে পরিপূর্ণ মানুষ। সে জন্যেই বলা হয়, মর, মরে যাবার আগে। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে নিজের নাফসকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত কর। তবেই দেখবে মৃত্যু তোমার জন্যে একটি চিরঞ্জীব অস্তিত্বের দুয়ার মাত্র। মু’মিন মরে না, মু’মিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে মাত্র। তেমন মোহন মৃত্যু আশা করি আমাদের সকলেরই কাম্য হবে।

প্রশ্নোত্তর পর্ব

আরও পড়ুন...

মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
প্রশ্ন: আমাদের এই যে ধর্মগ্রন্থ স্বয়ং আল্লাহ্ যাকে স্পষ্ট কিতাব বলেছেন, সে পবিত্র গ্রন্থে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বারণ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। এই সীমা লংঘনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝি না?
প্রশ্ন: আমাদের সমাজে কিছু শিক্ষিত লোক আছেন যারা আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না – রাসুলে পাক (সঃ)-কে মানেন না। কিন্তু এরা নামে মুসলমান, সামাজিকতা রক্ষার জন্য টুপি মাথায় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: প্রত্যেক শাস্ত্রেই একটা কথা জোর দিয়ে বলেন ‘নিজেকে জান’। খ্রিষ্টানরা বলে ‘Know Thyself’ হিন্দুরা বলে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। এ কথার অর্থ কি? আমরা তো সবাই নিজেকে নিজে চিনি, সুতরাং এর বাইরে নিজেকে জানার প্রয়োজন কি?
প্রশ্ন: আল-হামদের ব্যাখ্যা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। সূরা ফাতেহার এটি একটি শব্দ মাত্র। সম্পূর্ণ সূরাটি সম্পর্কে কিছু বললে আমার মত অনেকেই খুশী হবেন।
প্রশ্ন: আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না, একথা যদি সত্য হয় তাহলে মানুষ তার পাপের জন্য দোজখে যাবে কেন? ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ’। এ মারফতি গানটি তো আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন।

সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব 

শাহ্‌ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্‌ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন