মোজাদ্দেদে জামান হযরত আবু বকর সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)-এর সিলসিলার আলেম খলিফা ভক্ত ও মুরিদদের প্রতি লক্ষ্য করে ৯০-এর দশকে যে বক্তব্য রেখেছিলেন
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ)
ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)
বক্তব্য ও কথোপকথন
প্রশ্ন: আমি আবার একটা মানসিক সঙ্কটে ভুগছি?
উত্তর: আবার কি হলো তোমার।
প্রশ্ন: আচ্ছা আল্লাহতায়ালা কোরআনে বলেছেন, তিনি সৃষ্টির সর্বত্র বিরাজমান। সৃষ্টির সবকিছুই তিনি ধারণ করে আছেন। যদি তাই হয় তাহলে শয়তানও তাঁরই সৃষ্টি, সব মঙ্গলও তাঁরই মধ্যে বিরাজমান। শয়তান তাঁরই কাছ থেকে শক্তি পেয়েছে মানুষকে বিপথগামী করার। আবার তিনিই বলছেন, মঙ্গলের পথে এসো। কল্যাণের পথে এসো মানুষকে তার পথে আনার জন্যে যুগে যুগে তিনি পয়গম্বর পাঠিয়েছেন। এটা কি স্রষ্টার স্ববিরোধ নয়?
উত্তর: সৃষ্ট জগতের বাইরে আল্লাহর অস্তিত্ব কিরূপ জানি না। সেটাই তার যাত বা এসেন্স (Essence)। সেটাকে আমাদের স্থুলবুদ্ধিতে আমরা শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। সে এক সীমাহীন শূন্যতা, যার কোন কাল নেই, স্থান নেই, পাত্র নেই। স্থানকালের প্রশ্ন যেখানে উঠেছে সেখানেই তার সৃষ্টি। সে সৃষ্টি তিনি করেছেন আনন্দ অনুভূতি থেকে। ‘আমি নিজেকে চিনতে চাইলাম, তাই হে মুহাম্মদ, আমি তোমার নূরকে সৃষ্টি করলাম।’ সে মুহূর্তটি বিজ্ঞানের ভাষায় একটি অনন্যতা, যা কোন কার্যকারণ সূত্র দ্বারা শাসিত নয়। আল্লাহ বললেন ‘কুন’ – আর সেই সঙ্গে সব হয়ে গেল। এই সৃষ্টিতেই আমরা তার প্রকাশকে দেখি। এ প্রকাশের মধ্যে আলো যেমন আছে, তেমনি আছে অন্ধকার, মঙ্গল যেমন আছে, তেমনি আছে অমঙ্গল। দুয়ের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে, আর এ দিয়েই অভিনীত হচ্ছে সৃষ্টির নাটক। নাট্যকারের ইচ্ছায় কুশীলব চলছে, কেউ মঙ্গলকে আশ্রয় করে, কেউ অমঙ্গলকে। নাটকের পাত্রপাত্রী যেমন তার ভাগ্যলিপির জন্য প্রশ্ন করতে পারে না নাট্যকারকে, আমরা যারা এ জীবন নাট্যের অভিনেতা-অভিনেত্রী আমরাও বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের নাট্যকারকে তাঁর খেয়ালখুশি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি না। সুতরাং তিনি যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাকেই নতমস্তকে মানতে হয়। তিনি মঙ্গল-অমঙ্গলের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন, এ দুয়ের মধ্যে বেছে নেবার স্বাধীনতা মানুষকে দিয়েছেন। এ স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই জান্নাত-জাহান্নাম। মানুষকে এ স্বাধীনতা না দেওয়া হলে জান্নাত-জাহান্নাম থাকতো না। তবু একটা কথা মনে রেখো, মানুষ যখন তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি পাচ্ছে তখন সে শাস্তি স্রষ্টার বুকেই লাগছে সবচেয়ে বেশি। নাটক তিনি সাজিয়েছেন, তাই কষ্টও তাঁরই সবচেয়ে বেশি। তিনি শুধু চান মানুষ তাঁর বুকে ফিরে আসুক সেটাই তাঁর আনন্দ। সেটাই তাঁর প্রেম।
প্রশ্ন: আমাদের ধর্মের যে হুকুম-আহকাম, কোরআন-হাদিস এসবের উদ্দেশ্যই তো এক – মানুষের চরিত্র সংশোধন?
উত্তর: হ্যাঁ, এটা শুধু আমাদের কেন সব ধর্মেরই মূল কথা। অথচ এ কথাটা মানুষ সহজে বুঝতে চায় না। সে ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামায়, মারেফত লাভ করতে চায়, কিন্তু সহজ কথা সহজে বুঝতে চায় না। হুজুর পাক (সাঃ) এ কথা বার বার উচ্চারণ করেছেন। ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’ তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে যাও। কিন্তু আল্লাহর চরিত্র আবার কি? যিনি নিরাকার তার আবার চরিত্র হবে কেমন করে? হযরত আয়েশা (রাঃ) এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চরিত্র দেখনি’। রাসূলে পাক (সঃ) নিজে বলেছেন, ‘যারা আমাকে দেখেছে তারা আল্লাহকে দেখেছে।’ সুতরাং চরিত্রবান হতে গেলে চরিত্রের আদর্শ খুঁজতে হবে তাঁরই মধ্যে। রাসূলে পাক (সঃ) চরিত্র সম্পর্কে অনেক কথা আমাদের হেদায়েত করে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা জোহালত বা মূর্খতার জবাব মূর্খতা দিয়ে দিও না।’ অর্থাৎ অশালীন ব্যবহারের জবাব দিতে গিয়ে অশালীন হয়ো না। তোমরা জান, একবার হুজুর পাক (সাঃ) কে আবু জেহেল চড় মেরেছিল। এর জবাবে হুজুর পাক (সাঃ) আবু জেহেলকে চড় মারেন নি। রাসূলে পাক (সঃ)-এর শিক্ষার এমনই মাহাত্ম্য যে আরবের বর্বর বেদুইনও শ্রদ্ধায় মাথা দিয়েছিল। আমাদের ঈমান আছে বলে আমরা দাবি করি। কিন্তু ঈমান মানে শুধু কালেমা উচ্চারণ করা নয়। যে ‘লা’ বা নাই দিয়ে কালেমা শুরু, সে ‘লা’কে সত্য জেনে যে একমাত্র ইলাহকে স্মরণ করতে পারে, তার জন্য আর কোন ‘নাফসানিয়াত’ বা স্বার্থপরতা বাকি থাকে না। তাঁর ভালোবাসা এবং ক্রোধ দুই-ই সমর্পিত হয় আল্লাহর জন্যে। এজন্যই হুজুর পাক (সাঃ) বলেছেন, মানুষের রাগ এবং ভালবাসা যখন কেবল আল্লাহর জন্য হয় তখনই তার ঈমান পূর্ণ হয়। তোমরা খন্দকের যুদ্ধে হযরত আলীর সেই বিখ্যাত দ্বন্দ্বযুদ্ধের কথা নিশ্চয়ই শুনেছো। কোরাইশদের দলে একজন বিশালদেহী যোদ্ধা ছিল। খন্দকের যুদ্ধে আমর বিন আবু দাউদ নামে এ দৈত্যাকৃতি যোদ্ধা মুসলমানদের দ্বৈরথে আহবান জানিয়েছিল। কিন্তু তার বিশাল আকৃতি দেখে কেউই এগিয়ে গেল না। এদিকে সেই যোদ্ধা মুসলমানদের টিটকারী করতে থাকল। এ দেখে হযরত আলী (রাঃ) রাসূলে পাক (সঃ)-এর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে চোখের ইশারায় বারণ করলেন। এদিকে লোকটির আস্ফালন বাড়তেই থাকলো। হযরত আলী দ্বিতীয় বার অনুমতি চাইলেন। রাসূলে পাক (সঃ) তাকে এবারও মানা করলেন। তৃতীয় বারে রাসূলে পাক (সঃ) নিজের মাথার পাগড়ি খুলে হযরত আলী (রাঃ)-এর মাথায় বেঁধে দিলেন। তারপর নিজের হাতের তরবারিটি তার হাতে তুলে দিলেন। এই তরবারিটিই সেই বিখ্যাত জুলফিকার। যুদ্ধ শুরু হলে হযরত আলী (রাঃ) অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লড়ে তাকে ধরাশায়ী করলেন। তারপর তিনি তার বুকে চেপে বসে তার গলা কাটতে উদ্যত হলেন। আমর বুঝতে পারলো এই তার শেষ মুহূর্ত।
সুতরাং সে রাগে-দুঃখে হযরত আলী (রাঃ)-এর মুখে এক দলা থুথু ছুঁড়ে মারলো। এরপর আমর তার অন্তিম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কারণ, এত বড় অপমানের পর আলী (রাঃ) তাকে রেহাই দেবেন না সেটা সে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) ধীরে ধীরে তার বুক থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হতভম্ব আমর তার দিকে তাকিয়ে রইল। হযরত আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমর আমার তরবারি উত্তোলিত হয় আল্লাহর জন্য, আমার ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়। আমার মুখে তুমি থুথু দিয়েছ এখন আমি তোমাকে হত্যা করলে তা হবে প্রতিহিংসাপ্রসূত। সুতরাং আমি তোমাকে হত্যা করছি না। যাও তুমি তোমার বন্ধুদের মাঝে ফিরে যাও।’ হযরত আলীর (রাঃ) এ অভূতপূর্ব মহত্ত্ব থেকেই বোঝা যায়, মুমিনদের রাগ এবং ভালবাসা দুইই আল্লাহর শানে সমর্পিত। এ জন্যই রাসূলে পাক (সঃ) তাঁর বিরুদ্ধে সকল অপরাধকে ক্ষমা করেছেন কিন্তু তাঁর ধর্মের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করেছেন, প্রয়োজনে তাদের হত্যা করেছেন।
প্রশ্ন: রাসূলে পাক (সঃ) মানুষের চরিত্র শুদ্ধির জন্য যেসব কথা বলেছেন সে সম্পর্কে আরো কিছু বলুন?
উত্তর: রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই হচ্ছে দরিদ্রতম যে অন্যের ধন-দৌলত দেখে ঈর্ষান্বিত বোধ করে। আসলে ঈর্ষায় আক্রান্ত ব্যক্তির মত হতভাগ্য কেউ নেই। পৃথিবীর কোন ঐশ্বর্যই তার অভাব পূরণ করতে পারে না। সুতরাং আমাদের উচিৎ আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা এবং শোকর আদায় করা। আর এই লক্ষ্যে নামাজ পড়বে এমনভাবে যেন এই তোমার জীবনের শেষ নামাজ। তাহলেই দেখবে তোমার ভেতরের আলোতেই তুমি পথ দেখতে পাবে। আল্লাহর রহমত তোমার সমস্ত সত্তাকে ঢেকে রাখবে। তখন দেখবে মঙ্গলকে যেমন আল্লাহর দান বলে মনে করছো, সকল অমঙ্গলকে তেমনি তাঁরই দান বলে মেনে নিতে পারছো। আর সেদিনই অমঙ্গল তোমার কাছে পরাজয় স্বীকার করবে।
সূচী – প্রশ্নোত্তর পর্ব
শাহ্ মুহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ্ সিদ্দিকী আল-কোরায়েশী (রহঃ) ও
শাহ্ সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌন পুরি (রহঃ)-তাহাঁদের
বক্তব্য ও কথোপকথন